লিবিয়া থেকে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার সময়
ভূ-মধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নরসিংদীসহ বিভিন্ন জেলার ২৮ জন যুবকের নিখোঁজ
হওয়ার খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।
নিখোঁজের প্রায় দেড় মাস পর এ খবর পেয়ে নিখোঁজদের পরিবারে চলছে কান্নার রোল।
লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে
বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া যাওয়া বাংলাদেশী যুবকদের প্রায় দেড় মাস ধরে নিখোঁজ
থাকার পর তাদেরই সহযাত্রী একজনের কাছ থেকে পাওয়া গেল তাদের মৃত্যুর খবর।
মৃত্যুর পথ থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ৬
জনের মধ্যে হাসনাবাদ গ্রামের খোরশেদ মৃধার ছেলে ইউসুফ মৃধা, নিলক্ষা
গ্রামের ১ জন, বেলাবো উপজেলার ১ জন, বি-বাড়িয়ার ১ জন এবং মাদারীপুর জেলার ২
জন।
লোমর্হষক এই ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া
ইউসুফ মৃধা মুঠোফোনে বলেন, ২৭ জানুয়ারি লিবিয়ার স্থানীয় সময় রাত ৮টার দিকে
আমাদের বোট ছাড়ে। তখন আবহাওয়া খুবই খারাপ ছিলো। বোটে ধারণ ক্ষমতা ছিল ২৫
জন। সেখানে দুই জন চালকসহ ওঠানো হয়েছিল ৩৭ জন। ডবল ইঞ্জিনের বোট দেওয়ার কথা
থাকলেও বোটে ইঞ্জিন ছিল একটি। আমাদের কোনো সেফটি জ্যাকেটও দেয়নি। কারণ
লাইফ জ্যাকেট দিলে যাত্রী কম ধরবে। লিবিয়া থেকে রাত ৮টায় যাত্রা শুরু করে
ভোর ৩টার দিকে আমরা মাল্টার কাছাকাছি পৌঁছে যাই।
তিনি বলেন, এর মধ্যেই একজন বোট থেকে
পানিতে পড়ে যান। সে বলছিল ‘আমাকে তোরা উঠাবি না?’ তখন আমরা সবাই বললাম
ক্যাপ্টেনকে (নাবিক) তাকে নিয়ে নিতে। সাগর খুব উত্তাল থাকায় তাকে তুলতে
গিয়ে বোট একদিকে কাত হয়ে যায় এবং বোটে পানি উঠতে শুরু করে। একপর্যায়ে
আমাদের বোটটি উল্টে ডুবে যায়।
তারপর আমরা যে যেভাবে পেরেছি যেমন-
তেলের গ্যালন এটা-ওটা ধরে সাঁতার কাটতে থাকি। কিছুক্ষণ পর বোটটি একটু দূরে
ভেসে ওঠে। আমরা ১৫-২০ জন উল্টে যাওয়া বোটটি ধরি দুপাশ থেকে। ওই সময়
অন্ধকারের কারণে দেখা সম্ভব ছিল না সেখানে কে আছে আর কে নেই। এ অবস্থায়
প্রচন্ড ঠান্ডা পানিতে ভাসতে থাকি কোনো ভাবে। এর মধ্যে আমাদের শরীর বরফ হয়ে
আসছিল। ঢেউয়ের কারণে এক একজন ছুটে যাচ্ছে বোট থেকে। চোখের সামনে হাতের
মধ্যেই মৃত্যু হচ্ছে কারও কারও। লবণাক্ত পানি খেয়ে ফেলায় কয়েকজনের মুখ দিয়ে
রক্ত আসছিল। আস্তে আস্তে অনেকে পানির নিচে চলে যাচ্ছিল আমাদের দিকে বড় বড়
চোখ করে।
ইউসুফ বলেন, এমন করতে করতে প্রায় ১৩
ঘণ্টা কেটে গেল। ২৮ জানুয়ারি বিকেল হয়ে গেছে। তখন বেঁচে ছিলাম আমরা মাত্র
সাত জন। তখন অনেক দূর দিয়ে একটি টহল কোস্টগার্ডের বোট যাচ্ছিল। তারা দেখতে
পায় আমাদের এবং উদ্ধার করে। উদ্ধারের পর সাত জন থেকে রাশিদুল নামে একজনের
মৃত্যু হয়। আমাদের ছয় জনকে অজ্ঞাত এক জেলখানায় তিন দিন রাখা হয়। তিন দিন পর
আরেকটি জেলখানায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে গত বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) স্থানীয়
দূতাবাসের সহযোগিতায় দুজন দেশে ফিরেছি। অন্য চার জনও দ্রুতই দেশে ফিরবেন
বলে শুনেছি।
নিখোঁজ ইতালিযাত্রী যুবকরা হলেন -
নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার দক্ষিণ মির্জানগর গ্রামের এস এম তারুণ্য নাহিদ
(২৮), আগানগর গ্রামের ইমরান ভূইয়া (২১), হাসনাবাদ বাজারের আশিষ সূত্রধর
(২২), বালুয়াকান্দি গ্রামের সবুজ মিয়া (৩৮), হাইরমারা গ্রামের শাওন মিয়া
(২২), ডৌকারচরের আল-আমিন ফরাজী (৩৩), নাদিম সরকার (২২), দড়ি হাইরমারা
গ্রামের সেলিম মিয়া (৩৪), বেলাবো উপজেলার সল্লাবাদ ইউনিয়নের ইব্রাহীমপুর
গ্রামের সালাউদ্দিন (৩৫), শরিফুল ইসলাম (২৪), মো. হালিম (২৬), বিপ্লব মিয়া
(২৪), নারায়ণপুর ইউনিয়নের দুলালকান্দি গ্রামের মতিউর রহমান (৩২), এবং
ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার বাবুর কাইচাইল গ্রামের নাজমুল ইসলাম (১৯),
একই গ্রামের মইন মিয়া ফয়সাল (১৮), ও পিরোজপুর জেলার খানাকুনিয়ারি গ্রামের
রুহুল আমিনসহ (২৩) কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ,
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুর ও সিলেট জেলার বাসিন্দা। তাদের নাম জানা যায়নি।
নিখোঁজ ইতালিগামীদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
নিখোঁজ পরিবারের তথ্য ও অভিযোগের
সূত্রে জানা গেছে, বিগত ২৭ জানুয়ারি লিবিয়া সময় রাত ৮টায় লিবিয়া থেকে
ইতালির উদ্দেশ্যে ইঞ্জিনচালিত প্লাস্টিক নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে
দালালরা ৩৭ জন অভিবাসীকে নৌকায় তোলে। এ সময় অতিরিক্ত বোঝায় নৌকায় উঠেনি
রায়পুরা উপজেলার করিমগঞ্জ গ্রামের আঃ আউয়াল মোল্লার ছেলে ওয়াফিক মোল্লা,
নয়নসহ ৩ জন। তারা তাদের রুমে ফিরে যায় এবং তাদের চোখের সামনে ৩৭ জন ইতালি
অভিবাসীকে নিয়ে নৌকা ছেড়ে দেয়।
এরপর থেকেই পরিবারের সাথে যোগাযোগ
বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ইতালি যাওয়ার স্বপ্নবাজ বাংলাদেশি যুবকরা। এদিকে দালাল
চক্র নিখোঁজদের ফিরে আসার আশ্বাস দিয়ে চুক্তিবদ্ধ টাকা পেতে অভিবাসীদের
পরিবারে চাপ দিতে থাকেন।
দালাল চক্রের মূলহোতা নরসিংদীর রায়পুরা
উপজেলার আমিরগঞ্জ ইউনিয়নের আগানগর গ্রামের পরিমল সূত্রধরের ছেলে লিবিয়া
প্রবাসী মনির চন্দ্র শীল। হাসনাবাদ গ্রামের তারেক মোল্লা ও দালাল রাজিবসহ
বিভিন্ন অঞ্চলের অসংখ্য স্থানীয় দালাল বাংলাদেশ থেকে লোক জোগাড় করে দিতেন।
রায়পুরার মনির চন্দ্র শীল, ফরিদপুরের লিবিয়ায় অবস্থানরত দালাল রাসেল,
শাহিন, ইলিয়াসের মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানবপাচার হয়ে থাকে।
দালাল মনির চন্দ্র শীল হাসনাবাদ বাজারের
হারুন প্লাজায় সেলুন ব্যবসায়ী ছিলেন, বিকাশে টাকা লেনদেনের ঘটনায়
র্যাব-১১ তাকে আটক করে। মামলা হওয়ার পর তিনি লিবিয়া অবস্থান করেন।
শাওন মিয়ার পিতা কবির মিয়া বলেন, ২৭
নভেম্বর আমার ছেলে শাওনকে লিবিয়া পাঠানো হয় স্থানীয় লিবিয়া প্রবাসী মাহবুব
পাঠানের মাধ্যমে। সেখানে সে ভালো চাকরি করবে এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু
দালালচক্রের অতি প্ররোচনায় মনির দালালের সাথে ফোনের মাধ্যমে চার লাখ টাকা
চুক্তি হয়। চুক্তির চার লাখের মধ্যে ৩ লাখ টাকা তার মেসেজে পাঠানো এনসিসি
ব্যাংক মহিপাল শাখায় গত ২০ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে রহিমা সুলতানা পপি নামের
হিসাব নাম্বারে পাঠানো হয়। পরে আরো টাকা পাঠানোর কথা বলে। আমার ছোট ছেলেকে
যারা প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশ পাঠিয়েছে আমি তাদের সুষ্ঠু বিচার চাই। আমার মতো
আর কোনো পিতামাতার যেন বুক খালি না হয়।
নিখোঁজ নাদিম সরকারের বাবা সোবহান
সরকার বলেন, দালাল তারেক মোল্লার মাধ্যমেই রায়পুরার ১২ জনসহ বিভিন্ন জেলার
২০-২৫ জন লোক ইতালির উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। তাঁর ও মনির চন্দ্র শীলের
মতো দালালদের প্রলোভনের ফাঁদে পড়েই আজ ৩০টি পরিবারে কান্নার রোল উঠেছে।
তাঁদের কঠোর শাস্তি হলে এই ২৮ জনের আত্মা শান্তি পাবে।
সেলিমের বড় ভাই রতন মিয়া জানান, সেলিমের ২টি মাছুম সন্তান রয়েছে। দালালের খপ্পরে পড়ে জীবন দিতে হলো তাকে।
ইতালিগামী ওই যুবকদের মৃত্যুর খবরে
তাদের পরিবার-স্বজনসহ এলাকায় শোকের মাতম চলছে। অপরাধী দালাল চক্রের
অবৈধভাবে মানবপাচারের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন তাদের স্বজনরা।
নরসিংদী জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ
মারুফ খান জানান, দুঃখজনক বিষয়টি এই মাত্র শুনলাম। এছাড়া নিখোঁজ ব্যক্তিদের
পরিবারের কোনো সদস্যও আমাদের এ বিষয়ে কিছু জানাননি। এ বিষয়ে কতটুকু কি করা
সম্ভব, তা খোঁজ নিয়ে দেখব। স্থানীয় দালালদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা
নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন