• , |
  • ঢাকা, বাংলাদেশ ।
সর্বশেষ নিউজ
* ডেঙ্গুতে আরও ৭ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ১১৩৯ * সরকার কি চাইলে এখন রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দিতে পারে? * রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনের রাস্তা অবরোধ * পদত্যাগ করতে রাষ্ট্রপতিকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম * ১০১ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় দিন শেষ করল বাংলাদেশ * জামায়াত আমিরের সাথে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়কের সাক্ষাৎ * পুলিশের ২৫২ এসআইকে অব্যাহতিতে রাজনৈতিক কারণ নেই : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা * মাহফুজ আনামের কাছে প্রশ্ন: হাসিনা-মুজিবের দুঃশাসনের পার্থক্য কোথায়? * ইরানকে গোপন তথ্য দেয়ায় ৭ ইসরাইলি আটক * নিরাপত্তার স্বার্থে এখনই শীর্ষ নেতার নাম ঘোষণা করছে না হামাস

৫৬% কোটা পৃথিবীর কোথাও নেই

news-details

প্রতিকী ছবি


১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু সরকার ‘ইন্টেরিম রিক্রুটমেন্ট রুলস’-এর অধীনে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু করে। যে আইনের লক্ষ্য ছিল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে চাকরিতে বিশেষ সুবিধা দেয়া। কিন্তু সাময়িকভাবে চালু হওয়া এ কোটা পদ্ধতি জারি রয়েছে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও। শুরুতে ৮০ শতাংশ  কোটায় নিয়োগ হলেও একাধিকবার পরিবর্তন পরিমার্জন শেষে ৫৬ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। আর মেধারভিত্তিতে নিয়োগ পেয়ে থাকেন মাত্র ৪৪ শতাংশ। বিষয়টি নিয়ে চাকরিপ্রার্থী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। বিভিন্ন সময় এ কোটার বিরুদ্ধে চাকরিপ্রার্থীরা রাজপথে আন্দোলন করলেও ২০১৮ সালে তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকারের নির্বাহী আদেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল হয়। কিন্তু এক রিটের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি হাইকোর্ট কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। চেম্বার আদালতও উচ্চ আদালতের রায় আপতত বহাল রাখেন। এমতাবস্থায় আলোচনায় আছে কোটা কীভাবে চালু হয়েছে, কারা এর জন্য উপযোগী এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে কোটায় কীভাবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। 

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(৪) এ বলা আছে- ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ আর ২৯ (১) এ বলা হয়েছে- ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’ এ দু’টি ধারা অনুযায়ী সরকার চাইলে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা পদ্ধতি চালু করতে পারে।

কোটা পদ্ধতি প্রণয়নের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ‘ইন্টেরিম রিক্রুটমেন্ট রুলস’- এর আওতায় ১৯৭২ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর সরকারি চাকরিতে প্রথম কোটা পদ্ধতি চালু করে। সে সময় মেধার ভিত্তিতে ২০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ, নির্যাতিত নারী ১০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ৪০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭৬ সালের ৮ই এপ্রিল এতে সংশোধনী আনা হয়। সে সময় মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ বাড়িয়ে করা হয় ৪০ শতাংশ। আর মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, নির্যাতিত নারী ১০ শতাংশ আর জেলা কোটা ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এরপর ১৯৮৫ সালের ২৮শে এপ্রিল ফের পরিবর্তন আসে কোটায়। মেধা কোটা বাড়িয়ে করা হয় ৪৫ শতাংশ। আর মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, উপজাতি ৫ শতাংশ ও জেলা কোটা ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এরপর ২০১২ সালের ১২ই জানুয়ারি মেধা কোটা ১ শতাংশ কমিয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। 

শুরুতে এ কোটা কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত থাকলেও পরবর্তীতে তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদেরও যুক্ত করা হয়। তবে বিভিন্ন সময় এ কোটার ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন এলেও মুক্তিযোদ্ধা কোটা অপরিবর্তিত থাকে। এখনো ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান ভোগ করতে পারে। সেক্ষেত্রে ইচ্ছামতো কোটার সুবিধা নিয়ে থাকে। অন্যদিকে কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, সংবিধানে সাম্য ও সমতার কথা বলা হলেও বর্তমানে যে কোটা প্রচলিত রয়েছে তা মেধাবীদের সঙ্গে বৈষম্যের শামিল। দেশ ও প্রশাসনকে মেধাশূন্য করার জন্যই এ কোটা পদ্ধতি। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর ৫৬ শতাংশ কোটার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কোটা রাখতে হলে কেবল প্রতিবন্ধী, উপজাতিসহ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কোটা রাখা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, ৫৬ শতাংশ কোটা সংবিধানের স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটি কোনোভাবেই সাম্য ও মানবিক রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর নয়। আর সংবিধানের সংজ্ঞা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বলার সুযোগ নেই। তাই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা থাকতে পারে না। এছাড়া গণপরিষদ বিতর্কেও মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার কথা বলা হয়নি। পর্যালোচনা করে জানা গেছে, কোটা কেবল বাংলাদেশেই না পৃথিবীর নানা দেশে কোটা পদ্ধতি রয়েছে। যার মাধ্যমে দেশগুলোর সরকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সরকারি চাকরিতে সুযোগ দিয়ে থাকেন। ভারতে পাঁচ ধরনের কোটা রয়েছে। এর মধ্যে উপজাতি কোটা ৭.৫ শতাংশ; জাতভিত্তিক কোটা ১৫ শতাংশ; অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা; সংখ্যালঘু ও অন্যান্য অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা ২৭ শতাংশ। সবমিলিয়ে ৫৯.৫ শতাংশ কোটা  থাকলেও দেশটিতে কোটা ব্যবস্থার প্রয়োগে সুষ্ঠু নিয়ম রয়েছে। এ পাঁচ কোটার আওতায় যারা আসবেন তাদের পরিবার থেকে মাত্র একজনই এ সুবিধা নিতে পারবেন। আর যিনি কোটা সুবিধা নিচ্ছেন তিনি উচ্চশিক্ষা কিংবা চাকরি যে কোনো একটিতে কোটা ব্যবহার করতে পারবেন। 

পাকিস্তানে মাত্র ৭.৫ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। বাকি পদগুলোতে অঞ্চলভিত্তিক জনগোষ্ঠীর আলোকে নিয়োগ দেয়া হয়। এ নিয়মে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ পেয়ে থাকে পাঞ্জাব থেকে। এখানকার জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরিতে ৫০ শতাংশ কোটা রয়েছে। ইসলামাবাদও এ অঞ্চলের আওতাভুক্ত। এছাড়া সিন্ধু প্রদেশের শহর এলাকা থেকে ৭.৬ শতাংশ ও গ্রামীণ এলাকা থেকে ১১.৪ শতাংশ নিয়োগ পেয়ে থাকে। আর খাইবার পাখতুনের জন্য ১১.৫ শতাংশ, বেলুচিস্তান থেকে ৬ শতাংশ, গিলগিট-বালিস্তান ও কেন্দ্র শাসিত উপজাতীয় অঞ্চল থেকে ৪ শতাংশ এবং আজাদ কাশ্মীর থেকে ২ শতাংশ নিয়োগ দেয়া হয়। তবে সবমিলিয়ে ১০ শতাংশ নারীদের জন্য সংরক্ষিত। নেপালে দুই ধরনের কোটা রয়েছে। সাধারণ কোটায় ৫৫ শতাংশ আর সংরক্ষিত কোটায় ৪৫ শতাংশ। সংরক্ষিত কোটার মধ্যে নারীদের জন্য ৪৫ শতাংশ, উপজাতি ২৭ শতাংশ, মাদেশি ২২ শতাংশ, দলিত সমপ্রদায় ৯ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ৫ শতাংশ ও প্রত্যন্ত জনগোষ্ঠীর জন্য ৪ শতাংশ হারে ভাগ করা। মালয়েশিয়ায় জনগোষ্ঠীর বিবেচনায় চাকরির ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ মালয় জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ। বাকি ৪০ শতাংশ অন্যদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। কানাডায় নারী, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের জন্য কোটা রয়েছে। তবে কার জন্য কত শতাংশ কোটা বরাদ্দ রয়েছে তা স্পষ্ট নয়। এছাড়াও চীন, জাপান, শ্রীলঙ্কা, আফ্রিকাসহ ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশেই কোটা পদ্ধতি রয়েছে। তবে সেখানে কোটার ব্যবহারে সুষ্ঠু ব্যবস্থা রয়েছে। মূলত সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে জনসংখ্যার মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে বিশেষ কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন আদিবাসী, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, ভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র/দলিত শ্রেণি কিংবা সংখ্যালঘু সমপ্রদায় থাকতে পারে। 

একটি দেশের সার্বিক অবস্থা, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ নানা কাঠামোর উপরে নির্ভর করে এই জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা এবং বিশেষ সুবিধা বরাদ্দ করা হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, আমাদের সংবিধানে কোটার বিধান রয়েছে। সেটি নারী, প্রতিবন্ধী ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য। সরকার এদের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু এখানে জেলা কোটা কোনোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। আবার মুক্তিযোদ্ধারাও অনগ্রসর না। যেটি সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমাদের এখানে নারী, প্রতিবন্ধী, চা-শ্রমিক, দলিত, উপকূলীয় ও পার্বত্য এলাকার অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা রাখা যেতে পারে। এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের জন্য আমরা বিশেষ সুবিধা রাখতে পারি। তবে সেটি কোনোভাবেই ১০ থেকে ১২ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত না। ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা অযৌক্তিক, অন্যায্য এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিশেষ সুবিধা বঞ্চিত ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা থাকতে পারে। তবে  সেটা ১০ শতাংশের বেশি নয়। কোটার কারণে মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে। তাহলে শিক্ষার্থীরা কেন কোটা মেনে নেবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর ড. আফিস নজরুল বলেন, সংবিধানের কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাকরিতে কোটার ব্যবস্থার কথা বলা হয়নি। চাকরি সংক্রান্ত সুস্পষ্ট বিধান আমাদের সংবিধানে আর্টিকেল ২৯ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সবার সুযোগের অধিকার সমান। শুধুমাত্র নারী, শিশু এবং সমাজে যারা অনগ্রসর শ্রেণি আছে তাদের জন্য রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা করতে পারবে। তিনি বলেন, সংবিধান নিয়ে যখন আলোচনা হয়, গণপরিষদ বিতর্কে কোনো জায়গাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অনগ্রসর শ্রেণি বলা হয় নাই।


শহীদুল ইসলাম

মন্তব্য করুন