• , |
  • ঢাকা, বাংলাদেশ ।
সর্বশেষ নিউজ
* ডেঙ্গুতে আরও ৭ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ১১৩৯ * সরকার কি চাইলে এখন রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দিতে পারে? * রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনের রাস্তা অবরোধ * পদত্যাগ করতে রাষ্ট্রপতিকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম * ১০১ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় দিন শেষ করল বাংলাদেশ * জামায়াত আমিরের সাথে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়কের সাক্ষাৎ * পুলিশের ২৫২ এসআইকে অব্যাহতিতে রাজনৈতিক কারণ নেই : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা * মাহফুজ আনামের কাছে প্রশ্ন: হাসিনা-মুজিবের দুঃশাসনের পার্থক্য কোথায়? * ইরানকে গোপন তথ্য দেয়ায় ৭ ইসরাইলি আটক * নিরাপত্তার স্বার্থে এখনই শীর্ষ নেতার নাম ঘোষণা করছে না হামাস

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষা হবে?

news-details

ছবি: সংগৃহীত


টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সরকারি সফরে আজ চীন যাচ্ছেন। সরকারের চলতি মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর গত ২১-২২জুন অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার ভারত সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ভারতে দ্বিপক্ষীয় সফরে আলোচিত অনেক বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়নি বলে বিশ্লষকরা দাবি করছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো তিস্তা চুক্তি। আর ‘গঙ্গা ওয়াটার ট্রিয়েটি’র মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালে। সেটি নবায়ন করার বিষয় আলোচনা হলেও তিস্তা চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি। 

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে বিএনপিসহ অন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ করে আসছে যে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে কোনো অর্জন নেই। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে ভারতের রেল নেটওয়ার্কের বিরোধিতা করে আসছেন। অন্যদিকে সরকার বলছে এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের কানেক্টিভিটির অংশ। যেভাবে বাংলাদেশ ভারতের ভূখন্ড ব্যবহার করে ভুটান ও নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আনছে এবং আনবে। 

এদিকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের করা চুক্তি ও নথি সই করার সমালোচনা করে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি অভিযোগ করে বলেছেন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ফেলেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এজন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীকে চীন সফরে যেতেও ভারতের অনুমতি লাগে। 

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) উদ্যোগে যোগ দিতে ইচ্ছুক বাংলাদেশ। বিআরআই তত্ত্বটি নতুন বিশ্বায়নের একটি ধারণা। এতে প্রায় ৬০টি দেশ অংশ নিচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণই মূলত এই উদ্যোগের লক্ষ্য। এটিকে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রকল্প বলা হয়। 

বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাধীনতা উত্তর সময় থেকেই। বাংলাদেশের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার চীন। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীনের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বড় একটি প্রকল্প হলো তিস্তা মহাপরিকল্পনা। এই মহাপরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা নিয়ে আগে থেকে আলোচনায় ছিল চীন। তবে সম্প্রতি এটিতে আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কাকে দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে তা এখনো স্পষ্ট করা হয়নি। এক দিকে তিস্তা চুক্তি সই করেনি ভারত। আবার সেই ভারতই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখাচ্ছে! এটিকে নিয়ে বেশ জটিলতাও তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি উত্তরাঞ্চলের জেলা রংপুরে তিস্তাপাড়ের মানুষ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিজের দেশের অর্থায়নে করার দাবি জানিয়েছে। বিক্ষোভ সমাবেশ ও আন্দোলনও করছেন তারা। এটি ভারতের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা না হয় সে দাবিও তুলেছেন আন্দোলনকারীরা। সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ যে সিদ্ধান্ত নেবে, তা মেনে নেবে চীন। 

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর নিয়ে রোববার (৭ জুলাই) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, এই সফরে অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্পসহ সমঝোতা স্মারক সইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাত, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ডিজিটাল ইকোনমি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি খাতে সহায়তা, ষষ্ঠ ও নবম বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ নির্মাণ, বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশে সহজ শর্তে বিনিয়োগ করে থাকে চীন। আইএমএফ, এডিবিসহ অন্যান্য বৈশ্বিক ঋণদাতাদের চেয়ে যা অনেকটাই সহজ। বিবিসিক দেয়া এক সাক্ষাৎকারে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলছেন সুদের হার, শর্ত, প্রযুক্তি এবং কম খরচ হবে - এসব চিন্তা করেই বাংলাদেশ প্রকল্পগুলোর জন্য চীনের সহায়তা প্রত্যাশা করে বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, ‘প্রথমত ঋণটা সহজে পাওয়া যায়। অন্য দাতা সংস্থাগুলোর মতো দুই শতাংশ সুদেই ঋণ দেয় চীন। আর কস্ট বেনিফিট বিবেচনায় নিলে যেখান থেকে ঋণ পেলে সুবিধা সেদিকেই তো যাব আমরা। সে জন্যই চীন গুরুত্বপূর্ণ। ’অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর জন্য চীনের প্রযুক্তি বা খরচ অন্য দেশের তুলনায় কম হয় বলেও মনে করেন তিনি। কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের কারিগরি সহায়তা ও অর্থায়ন বেশ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া রাজধানীতে আরও কয়েকটি মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাথামিক অনেক কাজও করেছে। এসব প্রকল্পে কারিগরি ও অর্থায়ন দরকার হবে বাংলাদেশের। চীন এক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। 

আরেক অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিশ্ব ব্যাংকের যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে – সেগুলোতেও সুদের হার এখন আর কম নয়। বরং যেহেতু বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ দরকার সেখানে চীনের সাথে দরকষাকষি করে প্রকল্প চূড়ান্ত করা এখন 'অপেক্ষাকৃত সহজ' বলে তিনি মনে করেন। বিশ্ব ব্যাংক কিংবা এডিবির সাথে নেগোসিয়েশনে যত সময় লাগে চীনের ক্ষেত্রে তত সময় লাগে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে যেহেতু চীন ও ভারতে প্রস্তাব সামনে এসেছে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বেশ কৌশলী সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। তিস্তার সাথে ভারতে সম্পৃক্ততা অন্যদিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প। চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদের মতে, বাংলাদেশ চাইলে উভয় দেশকে তিস্তা প্রকল্পে যুক্ত করতে পারে। তিনি বলেন, চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার এবং চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ বড় অঙ্কের বিনিয়োগ পায়। ভারতকে খুশি রাখা আমাদের জন্য জরুরি, চীনকেও খুশী রাখা জরুরি। সুতরাং এমন হতে পারে যেহেতু প্রকল্পটা বড় সেজন্য প্রকল্পের কিছু অংশ আমরা ভারতকে করতে অনুরোধ করতে পারি এবং কিছু অংশ চীনকে। এইগুলো হতে পারে। এইসব ব্যাপার নিয়ে বিভিন্ন রকমের ধ্যানধারণা কী আছে চীন কীভাবে চিন্তা করছে সেইসব আলোচনা হবে।

ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা অনেক বেশি। চীনের বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ কিছু ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এবারের সফরে সেই বাধা কাটিয়ে উঠতে পারে কিনা তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে। 

রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখিয়েছে, চীনে গুনগত, মানসম্পন্ন ও বৈচিত্র্যময় পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ অতিরিক্ত ২৭ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে। উল্লেখযোগ্য বাধাগুলো হলো- ১. চীনা খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাব। ২. বিপণন, বিক্রয় ও বিক্রয়োত্তর পরিষেবাগুলোতে অপর্যাপ্ত অংশগ্রহণ। ৩. সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বাধা। ৪. চীনা লেবেলিং ও প্যাকেজিংয়ে কঠোর প্রবিধান।

চীন থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে থাকে বাংলাদেশ। অপরদিকে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য চীনে রপ্তানি করে থাকে বাংলাদেশ। এতে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের উচিৎ হবে সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা। চীনের বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত সুবিধাকে কাজে লাগানো। এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও যাতে বাংলাদেশ এই সুবিধা পায় তা নিশ্চিত করা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উল্লেখিত বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রীর সফরে কতটুকু সফলতার মুখ দেখবে তা এখন দেখার পালা। ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু সুসংহত হয় তাও হয়তো জানা যাবে  প্রধানমন্ত্রীর এই সফর শেষে। 


এম এ জিসান

মন্তব্য করুন