প্রতীকী ছবি
প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্ব এখন নতুন ধারায় ধাবমান। সারা বিশ্বের সকল মানুষ পরিবেশ পরিস্থিতি ও বাস্তবতার কারণে একটু ভিন্ন মাত্রায় অন্য আমেজে দিনাতিপাত করছে। প্রতিযোগিতায় এখন যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রয়োজন। বুদ্ধিভিত্তিক সমাজ এখন বোরাকের গতিতে উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর। যে দেশ ও সমাজ যত প্রযুক্তির উন্নয়ন ও দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছে, তারা তত বেশি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম। বিশেষ করে দেশের জনশক্তিকে কাজে লাগানোর নিরিখে যারা যত কৌশলী ও মানবসম্পদকে কর্মের খাতে পরিণত করতে পেরেছে , সে দেশ ও জাতি সার্থক।
বলা
দরকার যে কোন দেশের
সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের
প্রধান শর্ত হচ্ছে তার জনগণের দক্ষতা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন
ও প্রবৃদ্ধির প্রধান শর্ত হচ্ছে দেশের জনগণকে গুণগত, পরিমাণগত, যথাযথ জ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর
আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে এসে বিশ্ববাজার নির্ভর টেকসই দক্ষতা প্রদান করা ও অর্জনের আওতায়
নিয়ে আসা।
মূলত
যুগোপযোগী-জীবনমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষার
মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীকে মানব সম্পদে পরিণত করা ও তাদের অধিকার
সম্পর্কে সচেতন করে তোলা সময়ের দাবি।
দেশের
সর্বক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তিসহ বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার
প্রসার ঘটানো ও দক্ষ মানব
সম্পদ রফতানি এবং কারিগরি বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে
আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা বর্তমান শিক্ষানীতিতে সঠিকভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু তার আলোকে বাস্তব ক্ষেত্রে সাধারণ জনতাকে দক্ষতা উন্নয়নে কর্মক্ষম করার যে ধারা থাকা
দরকার, তার পরিকল্পনার আলোকে প্রয়োগ অনেকটাই কম।
বাংলাদেশে
একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল এবং স্থিতিশীল অর্থনীতি। এই অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য
সমূহের মধ্যে রয়েছে মধ্যম হারের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি (৬.২%) পরিব্যাপ্ত
দারিদ্র আয় বন্টনের অসমতা,
শ্রমশক্তির উল্লেখযোগ্য বেকারত্ব, জ্বালানি ও খাদ্যশষ্য এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য আমদানী নির্ভরতা, জাতীয় অসমতার নিম্নহার, বৈদেশিক সাহায্যের ওপর ক্রমত্রাসমান নির্ভরতা এবং কৃষিখাতের সংকোচনের ( ১৭.৫%) সঙ্গে
সঙ্গে পরিসেবা খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধি (৫৩.৯%)।
মূলতঃ বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামো দুর্বল হলেও এখানে অদক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা অঢেল এবং মজুরিও সস্তা।
বিশ্ব
ব্যাংক তাদের এক সমীক্ষায় বলেছে,
‘বাংলাদেশ তার অথনৈতিক উন্নয়নে আধুনিক কারিগরি ও প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাতে
অনেক পিছিয়ে রয়েছে। একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বড় শক্তি-সম্ভাবনা
হচ্ছে তার জনগণ।’ ইউএনডিপি, ইউনেস্কো প্রভৃতি বিশ্ব সংস্থা সবাই একই সুরে বলেছে, “বাংলাদেশ বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করে কাজে না লাগালে জাতীয়
উন্নয়নের গতিতে এগোনো সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে তার জনগণ ও শ্রমশক্তির গুণগত
মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে শ্রমবাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আধুনিক পেশাগত কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা
ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। বস্তুত, জনসংখ্যাকে অনেক দেশের জন্য জীবন্ত সম্পদ বলা হয়। এ সম্পদকে কাজে
লাগিয়ে অনেক দেশ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে। প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি জনসংখ্যাকে জনসম্পদে, অন্যকথায় মানব পুঁজিতে পরিণত করার মহা পরিকল্পনা নিয়ে জনবহুল দেশগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। কোন কোন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির
সাথে একটি ইতিবাচক ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যে
দেশ এ কাজটি সফলতার
সাথে সুসম্পন্ন করতে পারে সে দেশ তত
দ্রুত উন্নতির দিকে ধাবিত হয়। জনসংখ্যার তত্ত্বে নূন্যতম নির্ভরশীলতার অনুপাত বা lest dependency ration বলতে একটা কথা আছে। যখন কোন দেশ এই নূন্যতম নির্ভরতার
অনুপাতে চলে যায়, তখন ঐ দেশটির জনসংখ্যাতে
কর্মক্ষম জনসংখ্যার পরিমাণ সবচাইতে বেশী থাকে। এই কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে
কাজে লাগানোর উপায় হলো তাদেরকে শিক্ষা ও দক্ষতায় সমৃদ্ধ
করে তোলা। ফলে দেশের উন্নয়নের সকল কর্মকান্ডে অংশ নেওয়ার মত দক্ষ মানুষের
অভাব হয়না।
কারিগরি
শিক্ষা বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা
ও প্রশিক্ষণ মানুষের দক্ষতা উন্নয়ন ও কোন দেশের
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এর মত দেশ
তাদের জনসংখ্যাকে যথাযথ কারিগরি বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে
দক্ষ সম্পদে পরিণত করে যথেষ্ট উন্নতি লাভ করছে। আর এর বিপরীতে
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল শিক্ষা
ও প্রশিক্ষণ খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ করেও জনসংখ্যার দক্ষতা প্রদানে তেমন অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি। এরই মধ্যে আগামী ২০৩০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ কর্মক্ষম মানুষকে কিভাবে দক্ষ মানুষে পরিণত করা যায়, সে বিষয়টি নিয়ে
ভাববার সময় এসেছে, এবং রূপকল্প ২০৩০ কে নিয়ে বিশাল
পরিকল্পনা নিয়েও সে অনুপাতে এগিয়ে
যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও গবেষকরা। কিন্তু
যে ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে রূপকল্প ২০৩০ এগোনোর কথা, সে গতি থেকে
অনেকটা বিচ্যুতি ঘটেছে, বলে গবেষক-শিক্ষাবিদদের ধারণা।
বর্তমানে
বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত কর্মক্ষম জনসংখ্যা রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক পরিচালিত মনিটরিং এমপ্লয়মেন্ট জরিপ অনুযায়ী ৫৩.৭ মিলিয়ন
কর্মক্ষম জনসংখ্যার মধ্যে ৪০.২ মিলিয়ন
পুরুষ এবং ১৩.২ মিলিয়ন
মহিলা। এই কর্মক্ষম জনসংখ্যার
মধ্যে ৩৬.৯ মিলিয়ন
জনসংখ্যা কোন না কোন কর্মে
নিয়োজিত নয়, যার ৫.৭ পুরুষ
এবং ৩১.২ মিলিয়ন
মহিলা। কর্মে নিয়োজিত জনশক্তির অংশগ্রহণের হার ৫৯.৩%।
বাংলাদেশের শ্রমবাজারের জনশক্তির দক্ষতার ধরন এবং দক্ষতার লেভেল মূল্যায়ন করার মত কোন মেকানিজম
বা আইনগত পদ্ধতি বাংলাদেশে নেই। অনেকের বা অভিজ্ঞজনদের মতামত
হলো দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা
ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে শ্রমবাজারের সাথে সামঞ্জস্যহীনভাবে। সেক্ষেত্রে বলা দরকার যে বাংলাদেশে কর্মমুখী
শিক্ষার দৈন্যতা ও শিক্ষার গুণগত
মান নিম্ন, শ্রমশক্তির দক্ষতা কম, ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা কম। বাংলাদেশে মাথাপিছু শ্রমশক্তির অবদান ইউএস ডলারের শিল্পক্ষেত্রে ১১১, ভারতে ১৮৩, ইন্দোনেশিয়ায় ৫৯৬, মালয়েশিয়ায় ২.৬৬১, অষ্ট্রেলিয়ায়
৮.০৪৯ এবং জাপানে ১০.৭৯৪। সে
হিসেবে বাংলাদেশে মাথাপিছু শ্রমশক্তির অবদান ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় ১৯%, মালয়েশিয়ার তুলনায় ১.৪% এবং
অষ্ট্রেলিয়া ও জাপানের তুলনায়
১%।
কর্মমুখী
শিক্ষার অভাবে শ্রমশক্তির কর্মদক্ষতা কম উৎপাদনশীলতার ফাঁদ
থেকে বাংলাদেশকে বের হতে হলে গতিশীল ও পরিবর্তনশীল শ্রম
বাজারের কথা চিন্তা করে চাকুরিদাতা ও সরকারকে আগে
শিক্ষা বিভাগের দিকে নজর দিতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল
ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ইউকে ডিপার্টমেন্ট ফর
ইন্ট্যারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ও নরওয়ে সরকারের
সহযোগিতায় সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী
দেশে ৫০ হাজার অতি
ছোট এবং ১০ হাজার ক্ষুদ্র
ও মাঝারি আয়তনের হালকা প্রকৌশল শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। বাংলাদেশ
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অন্য এক গবেষণার তথ্য
অনুযায়ী এই শিল্প কারখানার সংখ্যা
৪০ হাজার আর কর্মরত শ্রমিক
৮ লাখ। এ সমস্ত শিল্পে
প্রায় ৩ হাজার ৮’শ রকমের যন্ত্র
ও যন্ত্রাংশ তৈরী হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে তিতাস বাখরাবাদ, জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানি, চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থা,
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা, বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, বন্দরকর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সিভিল-এভিয়েশন, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ করপোরেশন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন, বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরী
ছাড়াও মেরামতের ৮০ শতাংশ কাজই
করছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা।
অথচ অদক্ষ অর্ধশিক্ষিত কারিগর দ্বারা তৈরী হচ্ছে এসব মূল্যবান যন্ত্রাংশ। এ ক্ষেত্রে মোট
বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার কোটি
টাকা। নতুন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি
হচ্ছে গড়ে ৮০ শতাংশের ওপর।
কোন কোন ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন হাজার হাজার গুনেরও বেশী। উৎপাদন ও মেরামত যোগ
করলে এখাতের বার্ষিক টার্ন ওভারের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি
টাকা। সংশ্লিষ্ট এসব ক্ষেত্রে যে সব প্রতিষ্ঠানে
রয়েছে শিল্প ও মাঝারিখাত। তার
মধ্যে সমাজ সেবা অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদফর, জাতীয় মহিলা সংস্থা, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প
করপোরেশন, পল্লী কর্ম সহায়ক, কর্মসংস্থান ও রফতানি উন্নয়ন
ব্যুরো, বাংলাদেশ তাত বোর্ড, বন অধিদফতরসহ বিভিন্ন
বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প
(এস এম ই) খাতে
উৎপাদন বিপনন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যি বলতে এ সেক্টরে দক্ষ
জনবল সৃষ্টির গুরুত্ব না থাকায় এস
এম ই খাতে দক্ষ
জনবলের অভাব থেকেই যায়। মূলত দরকার ছিল সংশ্লিষ্ট সেক্টরে কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি ও দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি
তৈরির সে উদ্যোগ থাকা
দরকার ছিল। এটাই হলো আমাদের দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ব্যক্তিরা এখনো সেই উপলদ্ধি করছেন না
।
অন্যদিকে
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ পোশাক তৈরি
ও রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশে এ শিল্পে ২২
লাখেরও বেশি শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। যার মধ্যে ৮০% নারী শ্রমিক। আমাদের সবার জানা তৈরি পোশাক থেকে রফতানি আয় আমাদের মোট
রফতানি আয়ের প্রায় ৭৬ শতাংশ এবং
প্রতি বছর এথেকে আয় প্রায় ৩০
শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ শিল্পের শ্রমিকদের
বিদেশেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এ সেক্টরে
শ্রমিক তৈরির জন্য কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের উদ্যোগ সামান্যই।
সুতরাং
হালকা প্রকৌশল ও এস এম
ই খাতে কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ জনবল সরবরাহ করার নিমিত্তে আনুষ্ঠানিক কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা
বা কর্মমুখী শিক্ষা-প্রশিক্ষণের পাশাপাশি উপানুষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে
বিস্তৃত করার প্রয়োজনটা অতি জরুরি। সে জায়গায় বাংলাদেশ
শুধু পিছিয়ে নয় অনেক দূর
পিছিয়ে। যার ফলে এদেশের তরুণদের নানামুখী সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশের দক্ষ শ্রমিকদের বেশি টাকা পারিশ্রমিক দিয়ে বাংলাদেশের কলকারখানা পরিচালনার জন্য তাদের সহযোগিতা নেয়া ও কর্মস্থলের সুবিধা
দিতে হচ্ছে। তাতে এদেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে।
আমাদের
দেশের যোগাযোগ, অবকাঠামো বা উন্নয়নের কথা
বলে অসংখ্য বিদেশি এখন নিজেদের কর্মক্ষেত্র তৈরি করে গিয়েছেন, ইদানীং কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সাদা চামড়ার শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়ে অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও নিজেদের ব্রান্ডিং
করছে কর্তৃপক্ষ।
বিশ্বব্যাপী
রেমিট্যান্স প্রবাহের দেশভিত্তিক পরিসংখ্যান নিয়ে মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান “পিউ রিসার্চ” এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে
বলা হয়েছে, আমাদের এই বাংলাদেশ থেকে
বছরে ১৭ হাজার কোটি
টাকা বা সমপরিমাণ বৈদেশিক
মুদ্রা তাদের দেশে নিয়ে যায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৬ টি দেশের
নাগরিকরা এক বছরে বৈধ
উপায়ে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স
হিসেবে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেছেন ২০১ কোটি ৩০ লক্ষ মার্কিন
ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায়
১৬ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ অর্থ চলে যায় আশপাশের ৮/১০ দেশে।
সবচেয়ে বেশী যায় চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামে। বাংলাদেশে
বর্তমান কমবেশী প্রায় ১০ লাখ বিদেশি
কাজ করছেন। আর আর্থিক সংশ্লিষ্টদের
মতে বৈধ পথের বাইরে প্রতি বছর ৩০ হাজার কোটি
টাকা বিদেশে রেমিট্যান্স যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কারণ প্রতিদিন গড়ে বাংলাদেশী বিদেশি নাগরিকদের প্রায়ই অর্ধেকই দীর্ঘমেয়াদী অর্থ উপার্জনের সঙ্গে জড়িত হচ্ছেন। এতে একদিকে যেমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষস্থানীয় পদগুলো চলে যাচ্ছে বিদেশীদের দখলে, তেমনি বাংলাদেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে সীমানার বাইরে।
“পিউ
রিসার্চ” এর প্রতিবেদনে আরো
বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ থেকে মোট ১ বছরে ২০১
কোটি ৩০ লক্ষ মার্কিন
ডলার রেমিট্যান্স বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে চীনে
গেছে সর্বোচ্চ ৯ কোটি ৪৭
হাজার ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইন্দোনেশিয়ায় ২ কোটি ৭৫
হাজার ডলার, তৃতীয় সর্বোচ্চ মালয়েশিয়ায় ১ কোটি ৯৬
হাজার ডলার, চতুর্থ সর্বোচ্চ ভারতে ১ কোটি ১৪
হাজার ডলার ও পঞ্চম সর্বোচ্চ
যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে ৯৩ হাজার মার্কিন
ডলার।
এ
ছাড়া ভিয়েতনামে ৮৩ হাজার ডলার,
নেপালে ৬১ হাজার থাইল্যন্ডে
৫৭ হাজার, জাপানে ৫০ হাজার, নরওয়েতে
৪১ হাজার, যুক্তরাজ্যে ২৯ হাজার, মিয়ানমারে
২৮ হাজার, ব্রাজিলে ২০ হাজার, এবং
কম্বোডিয়ায় ৪ হাজার মার্কিন
ডলার রেমিট্যান্স বাংলাদেশ থেকে পাঠিয়েছেন সেসব নাগরিকরা। এই পরিসংখ্যান বৈধ
পথে পাঠানো অর্থের তবে বাংলাদেশের আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বাস্তবে এই অর্থের পরিমাণ
৩০ হাজার কোটি। বাংলাদেশে ঠিক কতজন বিদেশি নাগরিক কাজ করছে, তার পরিসংখ্যান রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যথাযথভাবে দিতে পারছেনা। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বিভাগ ভিন্ন ভিন্ন তথ্য উপাত্ত দেয়। বিদেশি নাগরিকদের কাজের অনুমতি দেয়া বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও এনজিও বিষয়ক
ব্যুরোর কাছে নিবন্ধিত বিদেশিদের সংখ্যা ১৫ হাজারের মতো।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় সংসদে দেয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে কাজ করা বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে রয়েছেন ৮৫ হাজার ৪৮৬
জনের মধ্যে ভারতীয় ৩৫ হাজার ৩৮৬
জন, চীনের ১৩ হাজার ২৬৮
জন, জাপানের ৪ হাজার ৯৩
জন, কোরিয়ার ৪ হাজার ৯৩
জন, মালয়েশিয়ার ৩ হাজার ৩৯৫
জন ও শ্রীলঙ্কার ৩
হাজার ৭৭ জন। বাকিরা
অন্যান্য দেশের । তবে এভাবে
বিভিন্ন খাতে কর্মরত বিদেশিদের অনেকেই পর্যটক হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন, এখন স্থায়ীভাবে আছে, অথচ কোথাও নিবন্ধিত নন।
মূলতঃ
বাংলাদেশী কর্মীর অভাব থাকায় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর বাইরে দেশীয় অনেক কোম্পানি এখন বিদেশিদের দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস কোম্পানি টেক্সটাইল মিল, ওভেন ও নিটওয়্যার ইন্ডাষ্ট্রি,
সোয়েটার ফ্যাক্টরী, বায়িং হাউজ, মার্চেন্ডাইজিং, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র, আন্তর্জাতিক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউজ, খাদ্য উৎপাদন ও বিপননকারী প্রতিষ্ঠান,
মোবাইল ফোন কোম্পানি, এয়ারলাইন্স, ফার্নিচার কোম্পানি, পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, চামড়াজাত প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি, মিডিয়া-প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনি সংস্থাসহ
বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে প্রায় ১০ লক্ষ বিদেশি
কাজ করছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতীয়। এর পরেই রয়েছে
শ্রীলঙ্কা, চীন, কোরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ আফ্রিকা, ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। একটি কোম্পানিতে পাঁচজন বাংলাদেশী কর্মকর্তার মোট বেতনের চেয়েও বেশি বেতন ও সুযোগ-সুবিধা
পেয়ে থাকেন একজন বিদেশি কর্মকর্তা। দেশের সম্পদ ও অর্থ বিদেশিদের
হাতে কেন যাচ্ছে, তার কয়েকটি মৌলিক কারণ উল্লেখযোগ্য-
১. দেশীয়
জনশক্তি কর্মমুখী শিক্ষায় বঞ্চিত ও চরম অদক্ষ।
২. দেশীয়
শিল্পের চাহিদানুযায়ী জনশক্তির দক্ষতার অভাব।
৩. এদেশের
জনবল-জনশক্তি দুর্বল প্রকৃতির ও পরিশ্রমী নয়।
৪. শিক্ষা
ব্যবস্থা মানসম্মত ও যুগোপযোগী নয়।
৫. আধুনিক
প্রযুক্তি জ্ঞানে অগ্রসর জনবলের খুবই অভাব।
৬. শিল্পোদ্যোক্তারা
দেশীয় জনশক্তি-জনবলের উপর আস্থাশীল নয়।
৭. অত্যাধুনিক
প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের যথেষ্ট পিছিয়ে পড়া।
৮. প্রশাসনিকভাবে
সংশ্লিষ্ট দফতরের উদ্যোগের অভাব।
৯. সরকারিভাবে
বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা রয়েছে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনীহা অনেক বেশি কাজ করে।
একটি
ঐতিহাসিক ব্যাপার উল্লেখ না করলে নয়।
১৩৪৭ সালে ইবনে বতুতা নামে একজন পরিব্রাজক বাংলাদেশে এসেছিলেন, এই পরিব্রাজক ও
পর্যটক ভারত হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর আসেন এবং তখনকার ইশা খাঁর রাজধানী বর্তমান নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে আসেন। তখনতার সম্পর্কে সামগ্রীক তথ্য নিয়ে তিনি হযরত শাহজালালের সাথে দেখা করে শ্রীলঙ্কা ঘুরে আবার স্বদেশ মরক্কোর চলে যান। দেশে যাবার পরে তার ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে ‘আররিহলা’ শীর্ষক অর্থাৎ ‘ইবনে বতুতার সদর নামা’ নামে এই বইতে বাংলাদেশের
অবস্থা বাস্তবতার প্রেক্ষিতে উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশ হলো জ্বলন্ত স্বর্গ।’ বাংলায় অনূদিত এ বইয়ে বাংলাদেশ
জ্বলন্ত স্বর্গের ব্যাখ্যায় তিনি কয়েকটি মন্তব্য করেন:
(ক) বাংলাদেশে দক্ষ
যোগ্য নেতৃত্বের অভাব।
(খ) বাংলাদেশে সুষম
বণ্টনের অভাব।
(গ) এদেশে ফলে-ফুলে সুশোভিত অনুকূল পরিবেশ থাকলে ও তার সদ্ব্যবহারের
অভাব।
দেশের
উন্নয়নে বিশেষ অন্তরায় দক্ষ-যোগ্য জনবল। তা আজ থেকে
প্রায় ৮ শ’ বছর
আগে একজন পরিব্রাজকের স্বল্প সময়ের সফরে তার অনুধাবনে ফুটে উঠেছে। বিধায় বর্তমান সময়ে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং সময় হলেও বিভিন্ন কারণে-অকারণে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ।
সামগ্রীকভাবে
বাংলাদেশের বাস্তবসম্মত কর্মমুখী শিক্ষা ও দক্ষ-যোগ্যতার
অভাবে ত্রিমুখী সমস্যায় জর্জরিত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
১. দক্ষ-যোগ্য ও কর্মমুখী শিক্ষার
অভাব এবং জনবল সংকটের কারণে সে জায়গায় বিদেশি
দক্ষজনবল ঢুকে
পড়ছে।
২. বুয়েট-বিশ্ববিদ্যালয়ের ও মেডিকেলের মেধাবী
শিক্ষার্থীরা তাদের সুযোগ্য মূল্যায়নের অভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, তাতে মেধা পাচারের মতো অপ্রত্যাশিত কাজ সংঘটিত হচ্ছে।
৩. অপরদিকে
বিদেশে যারা কর্মজীবী হিসেবে প্রতিবছর যাচ্ছে, তাদের ৯৯ ভাগই
কর্মমুখী শিক্ষা বঞ্চিত ও ভীষণ অদক্ষ
ও সময়ের চাহিদানুযায়ী একদম অযোগ্য।
দক্ষ
জনশক্তির অভাবে দেশ নানারকম সমস্যায় জর্জরিত। আর যারা দক্ষ
ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করছে তাদের বেশীরভাগ আবার বেকার সমস্যায় ভুগছে। মৌলিকভাবে
কর্মমুখী শিক্ষা ও দক্ষতার অভাবে
দেশে জনবল সংকট ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। নানারকম সমস্যসা নিয়ে
শ্রমিক হিসেবে যারা দেশের বাইরে যাচ্ছে। কোন দক্ষতা অর্জন না করেই বিদেশে
পাড়ি জমিয়েছেন। বর্তমানে সারা বিশ্বে ১৭৩টি দেশে
১ কোটি ২০ লক্ষের অধিক
বাংলাদেশী কর্মী বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রয়েছে তারা বছরে গড়ে ১৬ বিলিয়নের অধিক
মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করে থাকেন। যা দেশের অথনৈতিক উন্নয়নে
গুরুত্বের দাবিদার। আর তাদের পাঠানো
রেমিট্যান্স তৈরি পোশাকের পরে সবচেয়ে বেশী বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাত। এ খাত থেকে
প্রতি বছরে অর্জিত হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৫০০ কোটি মার্কিন ডলার এবং গত এক দশকে
রেমিট্যান্স হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হয়েছে প্রায় ১২ লাখ কোটি
টাকা। পরিবার পরিজন ও দেশের মায়া
ত্যাগ করে কর্মসংস্থানের জন্য প্রতি বছরে কয়েক লাখ মানুষ বিদেশে পাড়ি জমায়। দূর বিদেশে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা যে রেমিট্যান্স পাঠায়,
সে টাকায় দেশের মানুষ উন্নয়নের স্বপ্ন পূরণ করা হয়, কিন্তু সে শ্রমিকদের নিয়ে একবারও
ভাবা হয়না যে বিদেশে থেকে
যারা দেশের উন্নয়নের জন্য এতবড় ভূমিকা রাখছে তারা কতটুকু দক্ষ!
বিভিন্ন
কেসেমের মানুষ বিদেশ বিভুইয়ে গিয়ে ভালো থাকতে পারছেনা। তার অন্যতম একটি কারণ হলো বর্তমান পুঁজিবাদী ও কর্মমুখী শ্রমবাজারে
চায় দক্ষ শ্রমিক, কিন্তু আমাদের দেশ থেকে যারা যাচ্ছে, তাদের বেশীরভাগই অদক্ষ। বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত প্রায় ৫০ ভাগ শ্রমিকই
অদক্ষ। ২০ ভাগ অপল্পদক্ষ,
২৭ ভাগ দক্ষ এবং মাত্র ২ থেকে ৩
ভাগ প্রফেশনাল শ্রমিক। আবার আমরা যাদের দক্ষ বলি, তাদের মাত্র ১ মাসের একটি
ট্রেনিং দিয়েই দক্ষতার সনদ দিয়ে দিই। কিন্তু প্রফেশনাল চিন্তা করলে তারাও অদক্ষ।
ফলে
বাংলাদেশের শ্রমিকদের সাধারণত নিম্ন স্তরের ও স্বল্প বেতনে
কাজ করতে হয়, এজন্য আয় ও তুলনামূলক
কম হয়। বেশীর ভাগ শ্রমিক দেশে কৃষি কাজ করে আর বিদেশ গিয়ে
ভবন ও সড়ক নির্মাণ,
ইলেক্ট্রিশিয়ান, তৈরী পোশাক ও গৃহকর্মী ইত্যাদি
কাজে নিয়োজিত হয়। এবং দক্ষতার অভাবে কঠোর পরিশ্রম করে ও প্রাপ্য মজুরি
হতে বঞ্চিত হয়। বলতে গেলে ফিলিপাইন আমাদের চেয়ে কম সংখ্যক শ্রমিক
প্রেরণ করে প্রায় দ্বিগুণ রেমিট্যান্স অর্জন করে। এ থেকে বিশেষভাবে
অনুধাবন করা দরকার যে দক্ষতার অভাবে
আমাদের শ্রমবাজার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ও মার খাচ্ছে।
দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি ও তা বিদেশে
পাঠাতে পারলে রেমিট্যান্স অর্জন কয়েক গুণ বেড়ে যাবে, যা দেশের অর্থনীতিতে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শুধু সংখ্যায় না বাড়িয়ে উপযুক্ত
ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে কর্ম ও ভাষা দক্ষতাসম্পন্ন
মানব সম্পদ পাঠানো জরুরি। দক্ষতার অভাবে দালালের মাধ্যমে যখন কোন ব্যক্তি বিদেশ যায় তখন একপর্যায়ে বুঝতে পারে, তার দ্বারা কিছুই সম্ভব নয়। এক সময় দেখা
যায় সে ভিটেবাড়ি বিক্রি
করে সর্বস্ব নিঃশেষ করে বিদেশ গিয়েছে, তখন ফিরেও আসতে পারেনা। একপর্যায়ে মানসিক রোগ ও চাপে বিচলিত
হয়ে মারাত্মক অসুস্থ হয়। পাশাপাশি সে দেশে যে
অন্যান্য দেশের মানুষ তুলনামূলক অধিক পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে, আর বাংলাদেশী সবচেয়ে
নিম্নস্তরের কর্মচারী নির্ধারিত হয়। এক সময় এসব
কর্মীরা মানসিক রোগাক্রান্ত হয় ও আত্মহত্যার পথ
বেছে নেয়।
প্রবাসী
কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের
এক পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে দেখা গেছে-গত ২০০৫ থেকে
বর্তমান পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার অভিবাসীর
লাশ দেশে এসেছে। এদের মধ্যে প্রায় ১৩ হাজারই স্ট্রোকজনিত
কারণে মারা গেছে। তাতেই বুঝা যায় ভিনদেশে কতটা মানসিক প্রেসারে ভোগে আমাদের শ্রমিক ভাইয়েরা। এছাড়া শ্রমিকদের ভাষা জ্ঞানের অভাব তো আছেই। সর্বোপরি
কর্মমুখী শিক্ষা ও দক্ষতার অভাবে
এমন মর্মস্পর্শী আরো অনেক ঘটনা ঘটে।
অন্যদিকে
যখন বলা হচ্ছে বাংলাদেশে দক্ষ জনবল সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর। কিন্তু গবেষণায় বলছে প্রতি বছর লক্ষ তরুণ বেকার শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। এখানে তাহলে বাস্তবতার সাথে মিল পাওয়া যাচ্ছেনা। বিশ্ববিখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনোমিষ্টের ইকোনোমিষ্ট ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে “বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই
বেকার”। বেসরকারি গবেষণা
প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ
কর্তৃক পরিচালিত কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা
শীর্ষক সমীক্ষা মতে দেশে উচ্চশিক্ষিতের (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৪
শতাংশ। সেই তুলনায় কম শিক্ষিতের বেকারত্বের
হার কম। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়া বেকারত্বের হার ৭ দশমিক ৫
শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্কিলস ফর টুমরোস জবস’
শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “দেশের কলেজগুলো থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা ৭০ শতাংশই বেকার থাকে।
এবং বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২
শতাংশ”। সেন্টার ফর
পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “দেশে প্রতি বছর ২১ লাখ কর্মক্ষম
মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে”। কর্মসংস্থান তৈরী
হচ্ছে মাত্র ১৩ লাখের। কাজ
পাচ্ছেনা প্রায় আট লাখ কর্মক্ষম
মানুষ। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে , “যত উচ্চ শিক্ষিত,
তত বেকার বেশী”, বস্তুত শিক্ষিত মানুষ যে কোন কর্মসংস্থানে
দ্বিধাহীনভাবে যোগদান করে, কিন্তু উচ্চশিক্ষিতরা মান-সম্মানের দিকে তাকিয়ে যে কোন ছোটকাজে
যোগদান করেনা। একদিকে শুধু উত্তীর্ণ যা পাশ করেছে।
কোন অর্জন ও দক্ষতা বলতে
কিছুই নেই। তাহলে আধুনিক এ প্রযুক্তির বিশ্বে
কোন রকম অর্জন শুধু উচ্চশিক্ষিতদের সমাজের বাড়তি জঞ্জাল বললেও ভুল হবেনা। এজন্য দরকার কর্মমুখী শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন।
অবশ্য দেশে জনবল সংকট থেকেই যাচ্ছে।
অন্যান্য
দেশে যদি চুলকাটার মত সাধারণ ছোট
একটি কাজ করতে হয়, তাহলে সে বিষয়ে তার
ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্নকারী হতে হবে। অথচ বাংলাদেশে বিভিন্ন বিভাগের অধিদফতর থেকে শুরু করে পরিকল্পনা নেয়ার মতো অনেক পন্ডিত ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট বিভাগে নিয়োজিত রয়েছে, তারপরও অনাগত দিনের কথা চিন্তা করে দক্ষ-যোগ্য ও কর্মমুখী তেমন
কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেই। অথচ এদেশে বিভিন্ন শিল্প কারখানায় দক্ষ-জনশক্তির চাহিদা এখনও প্রচুর। যেমন পোশাক শিল্পের বাইরে সম্ভাবনাময় খাতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঔষধশিল্প। বাংলাদেশের ঔষধখাতের বাজার ইতিমধ্যে ২৪৪ কোটি ডলার। খাতটিতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১ লাখ ৭২
হাজার মানুষের, যার ৯৭ শতাংশই অদক্ষ।
এছাড়া দেশের উল্লেখযোগ্য শিল্পখাত কৃষি ব্যবসার ৯৯ দশমিক ৯
শতাংশই অদক্ষ শ্রমিক । অটোমোবাইল খাতের
প্রায় ৮৫ শতাংশ কর্মী
অদক্ষ। সম্ভাবনাময়, বেসরকারি খাতগুলো উল্লেখযোগ্য সিরামিক শিল্পের ৯২ দশমিক ৫০
শতাংশই অদক্ষ, বাংলাদেশের আরেক বড় শিল্পখাত চামড়া
ও চামড়াজাত পণ্য, এই শিল্পের ৯৯
দশমিক ৫ শতাংশ কর্মীই
অদক্ষ। একই অবস্থা হালকা প্রকৌশল শিল্প, চিংড়ি খাত, টেলিযোগাযোগ খাত ও পর্যটনশিল্পের মতো
বিশাল খাত, যেখানে দক্ষ-যোগ্য জনশক্তির অভাবে উন্নয়ন আজ সম্ভব হচ্ছেনা।
জনসংখ্যার রেশিও অনুসারে বৃদ্ধি থাকলেও সে তুলনায় দক্ষতা
ও কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে বাস্তব ক্ষেত্রে হোঁচট খেতে হচ্ছে। পরিকল্পনা খাতা-কলমে ততদিন পর্যন্ত পড়ে থাকবে, যতদিন বেকারের হাত কর্মের হাতে পরিণত না হবে। এজন্য
সময়ের চাহিদানুসারে পরিকল্পনার ধারা সেভাবে ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবি।
সর্বোপরি সকলকে অনুধাবন করা দরকার যে দেশে যত প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে, সেদেশের জনশক্তিও সেই মানের এবং দক্ষ ও প্রশিক্ষিত। বাংলাদেশে অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক দূরাচার ও উদ্যোগের অভাবে বেকারদের কর্মীতে রুপান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না। সময়ের চাহিদা ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে কর্মমুখী শিক্ষার আদলে ঢেলে সাজানো হলে দেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলায় রুপান্তর করা সম্ভব। এজন্য প্রশাসন ও সর্বস্তরের সচেতন জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষামন্ত্রণালয়কে আরও সক্রিয় ভূমিকার মাধ্যমে দেশের মেধাবী তরুণদের সত্যিকারে কর্মমুখী দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
লেখক: কলেজ অধ্যক্ষ ও গবেষক-কলামিস্ট
মো. আবুল কালাম আজাদ
মন্তব্য করুন