news-details

তারিকের তেলেসমাতি - ১

প্রতীকী ছবি


অনেক অনেকদিন আগের কথা। তখন তারিক এর বয়স মাত্র ৫ বছর। বৃহস্পতিবার সকাল, তারিকের বাবা অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে। তারিকের ঘুম ভেঙ্গে গেছে আরো অনেক আগেই। জানালার পাশে দাড়িয়ে বাইরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কেমন যেন উদাস আর ফ্যাল-ফ্যালিয়ে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে সে। ওদের বাসার জানালা দিয়ে দুরের মসজিদটা দেখা যায়। মসজিদের ছাদের উপরে প্রায়ই মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসার ছেলেরা ছুটাছুটি, দুষ্টামী আর খেলাধুলা করে বেড়ায়। প্রায়ই তারিক সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে। 

একদিন তারিক বাবাকে বলল- ‘আব্বু আমি তোমার সাথে মসজিদে যাবো’। বাবা উত্তর দিল- ‘আমি তো এখন অফিসে যাচ্ছি।

তারিক আবার বলল- ‘প্রতিদিনই কি তোমার অফিসে যাওয়া লাগে? ভাল্লাগেনা আমার।’ এক মুহূর্ত ভেবে বাবা বলল- আচ্ছা কাল তো শুক্রবার কাল তোমাকে আমি মসজিদে নিয়ে যাবো।

তারিক অবাক হয়ে বলল- ‘কেন! কালকে কি তুমি অফিসে যাবে না? বাবা উত্তর দিল- ‘না কালকে আমাদের অফিস বন্ধ।’ ও আবার বললো- ‘অফিস আবার বন্ধ থাকে কেন? অফিসে কি ইয়া বড় তালা লাগানো থাকে নাকি?

বাবার তো ঐদিকে অফিসের দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। তাই রেগে বলল- ‘হ্যা লাগানো থাকে। কাল তোমাকে মসজিদে নামাজ পড়তে নিয়ে যাবো।’...

মনে মনে ওর বাবা ভাবছে- কি যে আছে আমার কপালে কালকে। ও আবার বলতেছে- ‘আব্বু, ওও আব্বু আমি তোমার সাথে অফিসে যাবো।’ এ তো দেখছি মহা মুশকিল! (মনে মনে) বাবা বলল- ‘ঠিক আছে তুমি আরেকটু বড় হও তারপর তুমিও অফিসে যেতে পারবা।

তারিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ৮ টা ৪৫ বেজে গেছে খেয়ালই করা হয়নি। নাস্তা না করেই তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়ে যেতে হলো তাকে। ওর কথার উত্তর দিতে গিয়ে প্রায়ই বাসা থেকে বের হতে দেড়ি হয়ে যায়।

পরদিন সকাল হতে না হতেই কে যেন বাবার চুল ধরে টানছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই আবার কানের মধ্যে জোড়ে জোড়ে বাতাস অনুভব করলো তারিকের বাবা। কি ব্যাপার; এমন ঘটনা তো বাপের জন্মেও কখনো দেখি নাই! চোখ মেলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে তার। কোন রকমে একচোখ খোলে তাকিয়ে দেখে তারিক।

সে বাবার শুক্রবারের সকালের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। তার উপর আবার কানের মধ্যে ফুঁ মারতাছে। কেমন লাগে মেজাজটা? বাবা দিলো জোরে এক ধমক, ঐ কি করছো এসব??

ওমা! ধমক খেয়েও ফিক করে এবলার মতো হেসে তারিক বলল- আজকে না মসজিদে নিয়া যাবা আমারে। (সামনের দুটা কিঞ্চিত কালো দাত বের করে তখনও হাসছে...)।

তারিকের বাবা মনে মনে- শুক্রবার, একটু শান্তিতে ঘুমাবো। তাও জুটলো না এই বিচ্ছুটার জন্য। তারপর বললেন ‘বাবা এখনো সময় হয়নি নামাজের। সময় হলে নিয়ে যাবো। বলেই আবার ঘুমানোর চেষ্টা করল।

না! না! এখনই উঠো, আমাকে মসজিদে নিয়ে চলো- এক নাগালে বলতেই লাগলো তারিক। যাই হোক, ঘুমকে বলি দিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই উঠতে বাধ্য হলো ওর বাবা।

টিভিতে তখন কার্টুন চলছে। বাবা ভাবছে- আজকে কি যে আছে আমার কপালে!

বাসায় যখন নামাজে দাড়ায় তারিক কোথা থেকে এসে যেন হুট করে হাজির হয় আর বাবার পিছনে গিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে থাকে, কখন বাবা সেজদায় যাবে... সেই অপেক্ষায়। যেই না মাথা নিচু করে লাফ দিয়ে গলায় ধরে বাদরের মতো ঝুলে থাকে। এভাবে ঝুলেই থাকে যতক্ষন না সিজদা থেকে উঠে দাড়ায়। মনে হয় বাবা যেন ওর খেলার একটা উপকরণ। বাবা বুঝে না নামাজে দাঁড়ালেই কে খবর দেয় ওকে?? ওর তেলেসমাতি কাণ্ডে পরিবারের কেউ না কেউ কাবু হয় প্রতিদিন।

মনে হয় মিষ্টির দোকানে মিষ্টি সাজানোর পড়ে কোথা থেকে যেন মাছিরা খবর পেয়ে যায়। কোন এক অদৃশ্য শক্তি ঘোষণা করে- মিষ্টিওয়ালার মিষ্টি সাজানো শেষ এবার তোমরা খেতে আসতে পারো। ওমনি মাছিরা হুমড়ি খেয়ে মিষ্টি খাওয়ার উদ্ভোধন করে দেয়। মাছিরা কি তারিক কেও খবর দেয় নাকি আবার?

আবার মাঝে মধ্যে পাশে দাঁড়িয়ে নামাজের মধ্যে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে মন্ত্রপাঠ শুরু করে দেয়। বাবা ভাবছিলো... মসজিদে গিয়ে যদি এসব শুরু করে দেয় কি যে হবে আজকে?

যাইহোক, যথারীতি গোসল-ওযু শেষ করে তারিককে নতুন পাঞ্জাবী পড়িয়ে মসজিদের দিকে রওনা হলো ওরা।

আজকেই তারিকের মসজিদে যাওয়ার প্রথম দিন। এর আগে কখনোই মসজিদে আসেনি সে। পথের মধ্যে ওকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বলা হলো- মসজিদে গিয়ে যেন দুষ্টামী না করে। মানুষ পঁচা বলবে।

দুপুর ১ টা ১৫ মিনিটে নামাজ শুরু হবে। ওরা ১২ টা ৫০ মিনিটের মধ্যেই পৌছে গেলো। নিচতলায় জায়গা না পেয়ে দুতলায় উঠে পড়লো। ঐখানে আবার সব বাচ্চাদের মেলা। হই হুল্লোড় করছে সবাই যে যার মতো। বাবা ওকে নিয়ে এক কর্ণারে চলে গেলো যেন ওর দুষ্টামীতে অন্যরা কম বিরক্ত হয়। আস্তে আস্তে বড়রাও এসে হাজির হচ্ছে সেখানে।

বাবা ভাবছিলো- অন্য বাচ্চাদের দেখাদেখি তারিকও এই বুঝি দুষ্টামী শুরু করে দিবে। কিন্তু বাবার পাশেই চুপ করে বসে রইলো তারিক আর চারপাশটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে। হয়তো পর্যবেক্ষণ করে দেখছে কোথা থেকে শুরু করা যায়? কিভাবে শুরু করা যায়? একটু পরেই বাবার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো- ‘আব্বু কে কথা বলতেছে? দেখা যাচ্ছে না কেন?’

বাবা এতোক্ষনে খেয়াল করছিলো খুতবা পাঠের দিকে। বাবাও ফিসফিস করে বলল- ‘ইমাম সাহেব খুতবা দিচ্ছে নিচ তলায় বসে আর ঐযে... দেখছো কালো বাক্সের মতো উপরের কর্ণারে সাউন্ড বক্স ঐটা দিয়ে শব্দ হচ্ছে এখানে। খুতবা শুনো, খুতবা শুনা ওয়াজিব। এই সময় কথা বলা ঠিক না।’

তারিক- খুতবা! এাঁ! এাঁ! আবার কি? হুজুর তো কথা বলছে।

বাবা- হ্যা ঐটাই খুতবা/বক্তব্য। এবার মন দিয়ে শুনো। কথা বলো না।

খুতবা শেষ হলে নামাজের জন্য দাড়ানোর আহ্বান আসলো মাইকে। ওরা নামাজের জন্য দাঁড়ালো। তখনও মনে মনে বাবা ভাবছে সেজদায় গেলেই জিয়াদ তার কাঁধে ভর করবে।

বাবা তারিকের কানে ফিসফিসিয়ে লাস্ট ওয়ার্নি করে বলল- ‘আমি যা যা করবো তুমি ঠিক তাই তাই করবে, অন্য কিছু না।’ যদিও বাবা জানে তারিক কথা শুনার ছেলে না।

নামাজ শুরু হলেও অন্য বাচ্চারা সবসময়ের মতো দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলো, আবার কেউ কেউ কিলঘুসিও মারছে একে অন্যকে। বাবা রুকুতে গেলো, সেজদায়ও গেলো, সেজদা শেষও করল। বাবা তো যেমন আশ্চর্য তেমনি অবাক! ঠিক বড়দের মতো তারিক সবাইকে অনুসরণ করছে, সঠিকভাবে রুকু-সিজদা কমপ্লিট করছে তাও আবার সবার সাথে তাল মিলিয়ে। ঠিক পেছনেই অন্য বাচ্চারা যেখানে কেউ হাসছে, কথা বলছে, নানা রকম দুষ্টামীতে মেতে আছে। তারিকের বয়সী একটি বাচ্চা একটু পর পর তাদের কাতারের সামনে দিয়ে যাওয়া আসাও করছে বেশ কয়েকবার। এদিকে তারিক নামাজের সালাম ফেরানো পর্যন্ত কোন কথা তো বলেইনি বরং সুন্দরমতো সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করলো। ওর তেলেসমাতিতে বাবাসহ অন্য নামাজিরা তো বেশ অবাক!

চলবে..


মহিউদ্দিন সোহেল