ছবি: সংগৃহীত
মাহে রমজান। ইমানদারদের তাকওয়া অর্জনের মাস। হিজরী দ্বিতীয় বর্ষে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রোজা ফরজ হওয়ার আয়াত নাজিল করেছেন। এই রমজান মাসের মর্যাদা মহত্ব কোরআন কেন্দ্রিক। কোরআনের ভাষায়: ‘রমজানের মাস তো সেই মাস যে মাসে কোরআন নাযিল হয়েছে।’ ( সুরা বাকারা - ১৮৫)
রমজান মাসকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন ভাগে ভাগ করেছেন। তিনি বলেছেন, এর প্রথম ১০ দিন রহমতের, ২য় দশ দিন মাগফিরাতের এবং শেষ দশ দিন নাজাতের। অধিকাংশের মতে নাজাতের অংশের দশ দিনের মধ্যে রয়েছে মহিমান্বিত রাত। যে রাতে কোরআন মজিদ নাযিল হয়েছে।
আল্লাহ বলেন, ‘এই কুরআনকে কদরের রাত্রে নাযিল করেছি। তোমরা কি জানো এই কদরের রাতের পরিচয় কি? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর।’ (সুরা আল কদর ১-৩)
‘আমরা এটিকে নাযিল করেছি এক বরকতপূর্ণ রাতে। কেননা মানব জাতিকে সতর্ক করা আমাদের সিদ্ধান্তের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ ছিল সেই রাত যে রাতে আমার নির্দেশে প্রতিটি ব্যাপারে হিকমত পূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তোমার রবের পক্ষ থেকে রহমত স্বরূপ একজন রাসূল পাঠানো আমাদের সিদ্ধান্তের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি সবকিছু জানেন এবং শুনেন।" (সুরা দুখান ৩-৬)
রমজানের শেষ দশকের কোন এক রাতে এ মহিমান্বিত কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। আর ১৭ রমজান দ্বিতীয় হিজরীতে বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয়েছে ইসলামের প্রথম যুদ্ধ। ইসলাম ও কুফুরির প্রথম এ যুদ্ধের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে স্পস্ট দেখা যায় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নেতৃত্বে ছোট শহর মদিনা ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে একদিন গোটা বিশ্বে তারা নেতৃত্ব দেবে, এটা মক্কার কাফের কুরাইশরা তা বুঝতে পেরেছিল। বিশেষ করে সম্পর্কের দিক দিয়ে রাসূলের সাহাবীরা তাদেরই নিকটজন। রাসুলের অনুসারীদের আন্তরিকতা নিষ্ঠা এগুলো কাফেরদের কাছে অজানা ছিল না।
কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে বদর প্রান্তে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রাসুল (স.) এর সাথে তিনশত তেরো জনের কিছু বেশি সাহাবী ছিলেন। এদের মধ্যে দু'তিনজনের কাছে ঘোড়া ছিল আর মাত্র ৭০টি উট ছিল। যুদ্ধাস্ত্র ছিল খুব কম, ৬০ জনের কাছে বর্ম ছিল। অপর পক্ষে কাফেরদের ছিল বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও সমরসজ্জা। মোটকথা এ যুদ্ধ ছিল খুবই অসম যুদ্ধ। কিন্তু আল্লাহর অসীম রহমতে মুসলমান বাহিনী বিজয়ী হয়।
আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর ইচ্ছা ছিল নিজের বানী সমূহের সাহায্যে তিনি সত্যকে সত্যরূপে প্রকাশিত করে দেখিয়ে দেবেন এবং কাফেরদের শিকড় কেটে দেবেন, যাতে সত্য সত্য রূপে এবং বাতিল বাতিল হিসেবে প্রমাণিত হয়ে যায়। অপরাধীদের কাছে তা যতই অসহনীয় হোক না কেন। যখন তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছিলে, তখন তিনি প্রার্থণা কবুল করে বলেছিলেন আমি তোমাদের সাহায্য করবো একহাজার ফেরেশতা দিয়ে, তারা যাবে একের পর এক।
আল্লাহ এ ব্যবস্থা করেন একটি শুভ সংবাদ হিসাবে এবং এর ফলে যেনো তোমাদের মন প্রশান্তি লাভ করে। আসলে সাহায্য তো আল্লাহর কাছ থেকেই আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাবান।’ (সূরা আনফাল ৭-১০)
আল্লাহ বদর প্রান্তরে যাদেরকে সাহায্য করেছিলেন তারা ইতোপূর্বে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছে। মুহাজিররা মক্কায় ১৩ বছর আর মদিনায় দুই বছর। আনছারগন যদিও খুব কম সময় পেয়েছে, কিন্তু তারা তাদের যে ত্যাগ তিতীক্ষা আর ঝুঁকি নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজ দেশে নিয়ে এসেছে তা ছিল অতুলনীয় ঈমানের পরিচয়। যা সিরাত লেখকগণ বর্ণনা করেছেন।
সাহাবীগণ বিভিন্নভাবে নির্যাতন নিপীড়ন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ঈমানের পরীক্ষা দিয়েছেন কোরআনে বিভিন্নভাবে উৎসাহ ব্যঞ্জক নির্দেশনা এসেছে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের কে অবশ্যই পরীক্ষা করবো যাতে আমি তোমাদের অবস্থা যাচাই করে দেখে নিতে পারি তোমাদের মধ্যে কে জিহাদকারী এবং কে ধৈর্যশীল।’ (সুরা মুহাম্মাদ-৩১)
‘লোকেরা কি মনে করে রেখেছে, “আমরা ঈমান এনেছি” কেবলমাত্র একথাটুকু বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে, আর পরীক্ষা করা হবে না?" (সুরা আল-আনকাবুত-২)
দুনিয়ার জীবনে এই পরীক্ষা দিয়ে দুনিয়ার কোন লাভ নয় বরং আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালন শেষে জান্নাত লাভই ছিল এসব মুমিনদের একমাত্র লক্ষ্য। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে নিজেদের এ তাকওয়া ইমান মসজিদ বা খানকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং তারা জালেমের জুলুম উৎখাত করে মানুষের জন্য ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠার কাজে সক্রিয় হয়েছে। এ দায়িত্ব দিয়ে মূলত আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এটা খেলাফতের দায়িত্ব। বদর প্রান্তে একত্রিত হওয়া ছিল তাকওয়ার দাবি।
আজ আমাদের মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নেই। কিন্তু রয়েছে কুরআন ও সুন্নাহ। রাসুল (সা.) এর রেখে যাওয়া দায়িত্ব আমরা যারা উম্মতে মোহাম্মদী হিসেবে দাবি করি তাদেরকে পালন করতে হবে। এ দায়িত্ব কিভাবে পালন করতে হবে তা শেখানোর জন্যই যুগে যুগে নবী রাসুল এসেছেন। শেষ নবী তার দীর্ঘ ২৩ বছরের নবুয়তী জিন্দেগীতে বাস্তবে একটি বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। আর কেয়ামত পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালনের দায়িত্ব তার উম্মতকে দিয়ে গিয়েছেন।
এরই ফলশ্রুতিতে গোটা বিশ্বে ইসলাম কায়েমের আন্দোলন চলছে। বাংলাদেশের মানুষও পিছিয়ে নেই, ইমানের দাবীতে তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে।
‘যারা ঈমানের পথ অবলম্বন করেছে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। আর যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। কাজেই শয়তানের সহযোগীদের সাথে লড়ো এবং নিশ্চিত জেনে রাখো, শয়তানের কৌশল আসলে নিতান্তই দুর্বল।’ (সুরা আন-নিসা-৭৬)
এ লড়াই তথা দ্বীন কায়েমের নিয়মতান্ত্রিক পথে চলতে গিয়ে তারা জেল, জুলুম, গুম, খুন ইত্যাদির শিকার হচ্ছে। এর পরও তারা থেমে নেই, জনগণের বিপদ মুসিবতে সহযোগিতার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কোন প্রচার-প্রচারণা বা নেতৃত্ব হাসিলের জন্য নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে জান্নাতে যাওয়ার জন্যই হক্কুল এবাদের কাজ তারা করে। জনগণ এটা উপলব্ধি করে, ইসলামী সমাজ যারা চায় না তারাও বিশ্বাস করে এ দ্বীনি আন্দোলনের এসব মুজাহিদরা সততা আমানতদারিতার সাথে কাজ করতে পারে। অথচ ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জেল-জুলুম, ফাঁসি, দেশে টিকতে না পারার ব্যাপারে তারা নিশ্চুপ। কিন্তু এটাকে সাফল্য মনে করি।
আল্লাহ্ বলেন, ‘তোমরা কি মনে করেছো, এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে? অথচ তোমাদের আগে যারা ঈমান এনেছিল তাদের ওপর যা কিছু নেমে এসেছিল এখনও তোমাদের ওপর সেসব নেমে আসেনি। তাদের ওপর নেমে এসেছিল কষ্ট-ক্লেশ ও বিপদ-মুসিবত, তাদেরকে প্রকম্পিত করা হয়েছিল। এমনকি সমকালীন রসূল এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তারা চিৎকার করে বলে উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে? তখন তাদেরকে এই বলে সান্তনা দেয়া হয়েছিল, অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।’ (সূরা বাকারা-২১৪)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহর হুকুম পালনে মৃত্যু বরণ করা তার নাফরমানীর মধ্যে বেঁচে থাকার চেয়ে উত্তম।’ (হাদিস)
এই রমজান মাস। এমাসের ১৭ তারিখে বদর থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরকেও ময়দানে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ততক্ষণ কোন জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে।"(সুরা রাদ-১১)
ফেরেশতারা আসে সাহায্য করার জন্য। ময়দানে না থাকলে তারা কাদেরকে সাহায্য করবে?
ময়দানে সক্রিয় থাকার সাথে সাথে আমাদের কদরের তালাশে লেগে যেতে হবে। ধর্না দিতে হবে আল্লাহর দরবারে। শবে কদরে মানুষের ভাগ্যের ফয়সালা হবে কুরআনের ভিত্তিতে। আমরা সৌভাগ্যবান যে এ কোরআন পেয়েছি। আবার দুর্ভাগ্য আমাদের যে এত বড় সম্পদের অধিকারী হয়েও সেটাকে লাঞ্ছিত পদদলিত করছি।
ভাগ্যহারা দুর্গত সুস্থ মানবজাতিকে শান্তির পক্ষে কল্যাণের পথে পরিচালনার জন্য আমরা কদরের রাত্রিতে আল্লাহর কাছে ধর্না দিই। আমরা সিদ্ধান্ত নিই যাতে করে বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে এ পথে (সিরাতুল মুস্তাকিম) এর পথে টিকে থাকতে পারি। আল্লাহর কাছে হৃদয়ের আকুলতা নিয়ে দোয়া করি, নিজেদের ভুলত্রুটি গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। কোরআনের মর্ম বুঝার জন্য আল্লাহ যেন আমাদের হৃদয় খুলে দেন। মহান আল্লাহ গোটা বিশ্বের মানুষকে যেন খোদাদ্রোহী শক্তির গোলামীর কবল থেকে আল্লাহর গোলামীর করার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেন।
ইয়া রব! আমরা মুষ্টিমেয় গোনাহগার কিছু মানুষ, তোমার যে দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়াতে আমাদেরকে পাঠিয়েছো, কোরআন থেকে তা জানার পর তোমার জমিনে দ্বীন কায়েমের সংগ্রাম আমরা করছি। আমরা তোমার কাছে সেই ভাষায় ফরিয়াদ জানাচ্ছি যে ভাবে বদর প্রান্তরে রাসুল (স.) দোয়া করেছিলেন-
"হে আল্লাহ আল্লাহ! এই কুরাইশরা এসেছে তাদের সকল ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিকতা নিয়ে তোমার রাসূলকে মিথ্যা প্রমাণ করতে। হে আল্লাহ! এখন তোমার সেই সাহায্য আমরা কামনা করছি যার ওয়াদা তুমি করেছ। যদি আজ এই মুষ্টিমেয় দলটি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে এই পৃথিবীতে আর কোথাও তোমার এবাদত করার মত কেউ থাকবে না।"
শামসুন্নাহার বেগম