প্রতীকী ছবি (সংগৃহীত)
একাদশ সংসদের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে। যদিও বিরোধীদের পক্ষ থেকে এই সংসদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সীমাহীন। তারপরও আওয়ামী লীগ সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করতে যাচ্ছে। আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সর্বমহলে চলছে প্রস্তুতি। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সংস্থাও নির্বাচন আয়োজনে নিচ্ছে নানা প্রস্তুতি। দেশি-বিদেশি সংস্থা ও পর্যবেক্ষকদেরও তৎপড়তা চলছে অনেক দিন ধরেই। তবে নির্বাচন ও সংঘাত নিয়ে দ্বিধা ও শঙ্কাও বেড়েছে বহুগুনে।
দিন যতো ঘনিয়ে আসছে নির্বাচন নিয়ে তত সংঘাতময় পরিস্থিতির আশঙ্কা দানা বাঁধছে। বিরোধী দল শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি আহ্বান করলেও পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকার চেষ্টা করছে সরকারি দল। বিগত দিনে দেশের বেশ কিছু যায়গায় রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়ার ঘটনাও কম ঘটেনি। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে সকলের দায়িত্বশীল ভূমিকাই কেবল বড় ধরণের সংকট থেকে উত্তরণের পথকে সুগম করতে পারে।
দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিসহ অন্যান্য বেশ কয়েটি দল গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযেগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। পালন করে আসছে যুগপৎ ধারাবাহিক কর্মসূচি। রোডমার্চ, পদযাত্রা , প্রতীকী অনশন, বিক্ষোভ সমাবেশ, বিভাগীয় সমাবেশ, কর্মীসভাসহ নানা সিরিজ কর্মসূচি পালন করে আসছে। সরকার দলও জনসমাবেশ ও উন্নয়ন যাত্রার সমাবেশ করে আসছে। এগুলোর কতকগুলো আবার বিরোধীদের পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ। এমনকি বিএনপি কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তন করার সাথে সাথে আওয়ামী লীগও পরিবর্তন করেছে তারিখ। যা পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে থাকার চেষ্টারই অংশ।
সর্বশেষ গত ১৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়া পল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনের জনসমাবেশ থেকে আবারও আগামী ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটি। তবে একই দিন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা।
২৮ অক্টোবরের কর্মসূচিকে ঘিরে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে নানা মহলে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিববহন মন্ত্রী অভিযোগ করেছেন যে বিএনপি সারাদেশ থেকে লোক এনে ঢাকায়া বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তিনি এক সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের মাথায় ইউরেনিয়াম ঢেলে ঠান্ডা করে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ নিয়ে এক মন্তব্যে বলেছেন তারা বুড়িগঙ্গায় নৌকা বাইচ করতে পাঠাবেন বিএনপিকে। তবে বিএনপির ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে করবে সমাবেশ। দলটি ঢাকা মহানগরীর সকল ওয়ার্ড সহ আশপাশের জেলা থেকে ৫ লাখ লোক সমাগমের লক্ষ্য নিয়েছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও ২৮ অক্টোবর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলটি এই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তারা সরকাররের পদত্যাগ, দলের আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ নেতা-কর্মীদের মুক্তি, ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। ইতোমধ্যে কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারের সহযোগিতা চেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছে দলটি। তবে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জামায়াতের কর্মসূচি পালনে সরাসরি বাধা হয়ে দাঁড়াবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়। কারণ বিগত এক দশকের মধ্যে গত ১০ জুন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সমাবেশ করার সুযোগ পেয়েছিল জামায়াত। এরপর থেকে আবারও সরকার দলটিকে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দিচ্ছে না। এদিকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, ‘কেয়ারটেকার সরকারের দাবি না মানলে রাজপথ উত্তপ্ত হবে’। এতে ধরেই নেওয়া যায় এবারের পরিস্থিতি সহজ হবে না আওয়ামী লীগের জন্য।
বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার। আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ, তাহলো সব পক্ষ যেন শান্তিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।এর মধ্যে আছেন সরকারি কর্মকর্তারা, আইন প্রয়োগকারীরা, রাজনৈতিক দলগুলো, নির্বাচন কমিশন, মিডিয়া এবং অবশ্যই ভোটাররা। একই সঙ্গে সহিংসতা পরিহার করার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির শর্তগুলোও এখানে উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশি অনেক সংস্থা বাংলাদেশে নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণে এসেছিলেন। তারা দেশে নির্বাচনের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন এবং পর্যবেক্ষেক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যা সরকারের গ্রহণযোগ্যতাকে আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ বলে আপাতত প্রতীয়মান হচ্ছে।
আমরা যদি অতীতে নির্বাচনের আগে একটু রাজনৈতিক কর্মসূচির দিকে ফিরে তাকাই তাহলে সংকট ও শঙ্কার বিষয়ে একটু ধারণা নেওয়া যাবে। আগামী ২৮ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলো যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে তা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে । কারণ রাজনৈতিক দলগুলো একই রকম কর্মসূচি দিয়েছিল ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। সেসময় সংঘর্ষে বেশ কিছু মানুষ প্রাণ হারায়। লগি-বৈঠা নিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তির লাশের ওপর নৃত্য করতে দেখা গেছে। যেই ভিডিওগুলো এখনো সামাজিক মাধ্যমে ভেসে উঠে। আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশী অস্ত্র ব্যবহার করতেও দেখা যায় রাজনৈতিক কর্মীদের। বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভাষা ও কর্মসূচির ফলে জনমনে নতুন করে সেই পুরনো শঙ্কা দানা বাধছে।
সরকার সম্প্রতি আনসার সদস্যদের গ্রেফতারের ক্ষমতা দিয়ে সংসদে একটি বিল উন্থাপন করেছে। যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও বেশি ক্ষমতা দিয়ে বিস্তৃত করার পরিকল্পনার একটি অংশ বলেই মনে হচ্ছে। আসন্ন সংকটের সমাধানে সরকার কতটুকু আন্তরিক হয়ে এগিয়ে আসবে তার উপর নির্ভর করছে ঢাকার সোয়া দুই কোটি মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি। বিরোধীদের দাবি ও সরকারের অনড় অবস্থান গভীর সংকটে নিয়ে যেতে পারে দেশকে। নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে সরকারের পক্ষ থেকে ছাড় দেওয়ার বিকল্প নেই।
লেখক- মোহাম্মদ এ. জিসান
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোহাম্মদ এ. জিসান
মন্তব্য করুন