ছবি: এনএনবিডি
সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা বিশ্ববাসীকে আতকে তুলেছে। পৃথিবীর সর্বত্র নানা রকম দুর্যোগ প্রতিনিয়ত আঘাত হানছে। তবে দুর্যোগগুলোর অনেকাংশই মনুষ্য কর্মের কারণে সংঘটিত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বের আধুনিকায়নের নামে প্রকৃতির ভারসাম্যরক্ষাকারী উপাদানগুলোকে ধ্বংস করার কারণেও ঘটছে নানা দুর্যোগ। গত ২০২২ সালের নভেম্বরে মিশরে কপ-২৭ সম্মেলনেও এসব বিষয়ে উঠে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে অনেক দুর্যোগ হচ্ছে তাও স্পষ্ট হচ্ছে । ভালনারেবল দেশগুলো তাদের ক্ষতি পূরণের জন্য জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য দায়ী দেশগুলোকে প্রতিশ্রুতি পূরণের তাগিদ দিচ্ছে। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উন্নত দেশগুলো দায়ী।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে জলোচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড় বন্যাসহ এবং বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে থাকে। এছাড়া পৃথিবীতে অতিরিক্ত কার্বন নিঃস্বরণের কারণে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে হিমবাহ গলে যাওয়ায় সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় আরও বড় ধরণর বিপর্যয় হতে পারে। এগুলোর বেশিরভাগই মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কাতারে পড়ে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কে ভূমিকম্পে সাড়ে ৬ হাজারের অধিক বিদেশিসহ ৫০ হাজারের অধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। যা সাম্প্রতিক আঘাত হানা ভূমিকম্পগুলোতে হতাহতের দিক থেকে সর্বোচ্চ।
অন্যদিকে মানুষের অব্যবস্থাপনার কারণে দুর্যোগকালীন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। দুর্যোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থার পূর্বপ্রস্তুতি থাকলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। প্রশান্ত মহাসাগরের বহিঃসীমানা বরাবর সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প হয়। এ অংশের জাপান, ফিলিপাইন, চিলি, অ্যালিসিয়ান দীপপুঞ্জ ও আলাস্কা সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত।
আর ভূমধ্যসাগরীয়-হিমালয় অংশেও রয়েয়ে বেশ কয়েকটি দেশ। এ অংশ আল্পস পর্বত থেকে শুরু করে ভূমধ্যসাগরের উত্তর তীর হয়ে ককেশাস, ইরান, হিমালয়, ইন্দোচীন ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ হয়ে নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত।
ভৌগলিক আয়তনের হিসাবে বাংলাদেশে অতীতে আঘাত হানা ভূমিকম্পে হতাহতের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছে। এরপর ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পে দেড় হাজার মানুষ মারা যায়।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুই যুগের গবেষণায় দেখা গেছে, ইন্ডিয়া প্লেট ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে দীর্ঘসময় ধরে কোন ভূমিকম্পের শক্তি বের হয়নি। ফলে সেখানে ৪০০ থেকে হাজার বছর ধরে শক্তি জমা হয়ে রয়েছে।
গবেষণায় আরও উঠে এসছে যে, ইন্ডিয়া প্লেট পূর্ব দিকে বার্মা প্লেটের নীচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মা প্লেট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে।
ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েকটি প্লেট থাকার কারণে এসব এলাকা ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভু-তত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, ‘উত্তরে তিব্বত সাব-প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট এবং দক্ষিণে বার্মা সাব-প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ফলে সিলেট-সুনামগঞ্জ হয়ে, কিশোরগঞ্জ চট্টগ্রাম হয়ে একেবারে দক্ষিণ সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে।’
এমতাবস্থায় সুনামগঞ্জ, জাফলং অংশে ডাউকি ফল্টের পূর্বপ্রান্তেও ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। এসব ফল্টে ভূমিকম্প হলে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বা বিপদের মাত্রা অনেক বেশি বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।
সম্প্রতি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে ভবিষ্যতে ভূমিকম্পের কারণে দেশে কি পরিমাণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির হতে পারে তার কিঞ্চিত পরিসংখ্যানও উঠে এসেছে। সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয় ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের একটি বাজেটের তিনভাগের একভাগ।
রাজউকের সমীক্ষাটিতে আরও বলা হয়, মধুপুর চ্যুতিরেখায় ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় মারা যেতে পারেন ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ। ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়বে। আহত হবেন ২ লাখ ২৯ হাজার। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে সরকারকে ব্যয় করতে হবে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার (৪ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা)।
৫৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের রাজউক অংশের আওতায় সমীক্ষাটি করেছে রাজউক। এতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
প্রকল্পটির পরিচালক আবদুল লতিফ হেলালী গণমাধ্যমকে বলেন, ২০১৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত এই চার বছর ধরে ভূমিকম্পের ভয়াবহতা নিয়ে বড় আকারে এ ধরনের সমীক্ষা প্রথমবারের মতো করা হয়েছে।
সিলেটের ডাউকি চ্যুতিরেখায় ৭ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ঢাকার কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫টি ভবন ধসে পড়বে বলে সমীক্ষাতে তুলে ধরা হয়। সমীক্ষায় ভূমিকম্পের সময় বিবেচনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের তারতম্যও তুলে ধরা হয়। সে আলোকে বলা হয় দিনের বেলায় ভূমিকম্পটি হলে ১৬ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। আহত হবেন ২৮ হাজার মানুষ। এই মাত্রার ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে ৫ বিলিয়ন ডলার, যা সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকার সমান। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার (সাড়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকা)।
সমীক্ষায় একটি ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এসেছে যা বসবাসকারী নাগরিকদের জন্য চরম উদ্বেগের এবং তা শনাক্ত করাও কঠিন। ঢাকায় ভবনগুলোর ধসে পড়ার ঝুঁকির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে অনেক ভবন জলাভূমি ভরাট করে নরম মাটিতে তৈরি করা হয়েছে। আবার নির্মাণের ক্ষেত্রেও ভূমিকম্পসহনীয় করা হয়নি। অনেক ভবনই অবৈধভাবে নির্মিত।
ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ স্ট্রাকচারাল রিস্ক অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ইনস্টিটিউট (বিএসআরআরআই) নামে একটি স্বতন্ত্র ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছে রাজউক। যেটি ভূমিকম্প নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করবে। প্রস্তাবনায় এই ইনস্টিটিউটের লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ভূমিকম্প ও দুর্যোগ সহনশীল নগর নির্মাণে গবেষণা করা এবং দুর্যোগ–পরবর্তী কার্যক্রমে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি সেবা দেয়া। এতে ভূমিকম্প সম্পর্কে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
সমীক্ষাটি করা হয়েছে রাজনীতিবিদদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য, যাতে তাঁরা ভূমিকম্পের ভয়াবহতা ও গুরুত্বটা বুঝতে পারেন এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নেন। দেশ পরিচালনায় যেহেতু রাজনীতিবিদরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, সেহেতু তাদেরই আগে এসব বিষয়ে অনুধাবন ও কার্যকরী পরিকল্পনা নিতে হবে। অনাগত প্রলংয়ঙ্করী ভবিষ্যতের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে। রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ ভবনের বিষয়ে এখনি নিতে হবে পদক্ষেপ। পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে সাহসী ভূমিকা পালন করতে হবে।
আবু জায়েদ আনসারী
মন্তব্য করুন