• , |
  • ঢাকা, বাংলাদেশ ।
সর্বশেষ নিউজ
* স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের আন্দোলন স্থগিত * সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান মির্জা ফখরুলের * অবসর নিয়ে এখনও ভাবছেন না মেসি * রাশিয়া ন্যাটোকে আক্রমণ করবে না : পুতিন * এইউবিতে “দারিদ্র বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা” শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত * আম্পায়ার হিসেবে আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি সৈকত * রাজনীতিতে আসছেন সানিয়া মির্জা! * অর্থ আত্মসাতের মামলায় কারাগারে মেজর মান্নান * বিএনপি স্বাধীনতার মর্মার্থকে অকার্যকর করতে চায় : ওবায়দুল কাদের * নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো অর্থ নেই ভারতীয় অর্থমন্ত্রীর

বিএনপি’র সমাবেশে কারা আসছে, কেন আসছে?

news-details

ছবি : সংগৃহীত


পটুয়াখালীর জাকির হোসেন গাজী। বয়স ষাটের কাছাকাছি। গ্রামে কৃষি কাজ করেন। আগে কখনো কোনো দলের মিছিল-মিটিং-এ যাননি। এবারই প্রথম বিএনপি’র বরিশাল বিভাগীয় সমাবেশে আসেন। কেন সমাবেশে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সমাবেশ দেখার জন্য বরিশালে এসেছি। ৩দিন আগেই সমাবেশস্থলে পোঁছাই। শীত ও কুয়াশার মধ্যে মাঠেই রাতযাপন করি। সবকিছুর দাম বেড়েই যাচ্ছে। সরকার কোনোকিছুর দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।

এতে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। আমরা এখন পরিবর্তন চাই। পরিবর্তন হলে হয়তো একটুু ভালো থাকতে পারবো। 

জাকির হোসেন গাজীর মতো আরও অনেকে বিএনপি’র সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন যারা রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন। তাদের কোনো পদ-পদবি নেই। তারা আসছেন নিজের তাড়না থেকে।

এমন অনেক মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, পরিস্থিতির কারণে তারা স্বেচ্ছায় সমাবেশে এসেছেন। পকেটের টাকা খরচ করে এসেছেন। তারা মনে করেন সামনে একটি ভালো নির্বাচন হওয়া দরকার। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে তাদের জীবন-জীবিকা সামনে সহজতর হতে পারে এমনটি ধারণা করেন কেউ কেউ। 

৮৬ বছর বয়সী চাঁন মিয়া। পটুয়াখালীর গলাচিপা থেকে নানা বাধা পেরিয়ে বরিশালে বিএনপি’র সমাবেশস্থলে আসেন। ৩ দিন আগেই সমাবেশস্থলের সামনে স্যাঁতস্যাঁতে সবুজ ঘাসের ওপর বিছানা পেতে রাতযাপন করেন। আসার পথে বাড়ি থেকে চিঁড়া ও পাকা কলা নিয়ে আসেন। এসব খেয়েই তিনদিন পার করেন তিনি। চাঁন মিয়া বলেন, এই শেষ বয়সেও আমাকে সমাবেশে আসতে হয়েছে। আমি যুদ্ধ দেখেছি। তখন আওয়ামী লীগের ডাকে যুদ্ধ করেছি। এখন দেশ আস্তে আস্তে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমরা ভোট দিতে পারছি না। খাদ্য দ্রব্যের দাম বাড়তি। ভোটের অধিকার ফিরে পেতে চাই। প্রয়োজনে ৮৬ বছর বয়সেও আবার যুদ্ধ করবো।

মির্জাগঞ্জের মুজিতবাড়ি ইউনিয়নের মোজাম্মেল হোসেন মৃধা বলেন, এই সরকার ভোটের অধিকার হরণ করেছে। গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে। দ্রব্যমূলের অবস্থা নাগালের বাইরে। 

মানুষ অনাহারে দিন যাপন করছে। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে দিশাহারা। প্রতিটি সেক্টরে দুর্নীতি। এজন্য এই সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানানোর জন্য বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশে যোগ দিয়েছি। যানবাহন বন্ধ তবুও মির্জাগঞ্জ থেকে পায়ে হেঁটে আসছি। মনে আতঙ্ক ছিল। তবুও দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এসেছি। 

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচরের বাসিন্দা আব্দুল হাই। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা ট্রলার চালিয়ে বরিশালে বিএনপি’র সমাবেশে যোগ দেন। সমাবেশে আসার সময় নিজের ট্রলারে আরও ২১ জন নিয়ে আসেন। কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে ট্রলার বেঁধে রেখে সমাবেশে ঢুকতে চেষ্টা করেন। তবে মানুষ ঠেলে ভিতরে ঢুকতে না পেরে ফের ট্রলারে বসে বক্তব্য শোনেন। 

তিনি বলেন, আমি ট্রলারের মাঝি। নদীতে-সাগরে মাছ শিকার করি। কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই। কয়েক বছর আগে আমার সাভার (মাছ ধরার নৌকা ও জাল) দখল করে নেয় আওয়ামী লীগের লোকজন। আমার ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। কোনোরকমে জীবন বাঁচাই। তখন প্রতিবাদ করার সাহস পাইনি। আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এখন সময় এসেছে। আর কাউকে ভয় করি না। নিজের মাছ ধরার ট্রলার নিয়ে, নিজ খরচে এলাকার লোকজন নিয়ে বিএনপি’র সমাবেশে অংশ নিয়েছি। এই সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছি। 

গাজী আব্দুর রশিদ। বয়স নব্বইয়ের বেশি। শরীরে ভর করেছে বার্ধক্য। চলার শক্তি নেই। অন্যের সাহায্য নিয়ে পথ চলেন। তবে বিএনপি’র জন্য অন্যরকম ভালোবাসা তার। দলের জন্য শত কষ্ট হলেও তা নীরবে সহ্য করতে পারেন। বরিশাল বিভাগীয় বিএনপি’র সমাবেশে অংশ নিতে তিনদিন আগে বরগুনা থেকে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে আসেন তিনি। বরগুনা সদর আয়লাপাতা কাটা ইউনিয়নের তার বাড়ি। কথা হলে তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দেশে অশান্তি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এসব দেখে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। এখান থেকে আমরা মুক্তি চাই। এজন্য বিএনপি’র ডাকে বরিশাল বিভাগীয় সমাবেশে তিনদিন আগেই উপস্থিত হয়েছি। রাতে সমাবেশস্থলে রাত্রি যাপন করি। এতে কষ্ট হলেও কোনো দুঃখ নেই। অধিকার আদায়ের জন্য আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। এই বৃদ্ধ বয়সেও চাই দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হোক।

মো. শামীম। বরগুনা থেকে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে আসেন সমাবেশের ২দিন আগে। দলীয় কোনো পদ-পদবি নেই। পেশায় দিনমজুর। দৈনিক আয় দিয়েই কোনো রকমে পরিবারের ভরণ- পোষণ করেন। মাঝে-মধ্যে কষ্ট হয়ে যায়। আয় না হলে না খেয়েই থাকতে হয় পুরো পরিবারকে। সমাবেশে আসার কারণ জানতে চাইলে  বলেন, এই সরকার সবকিছুর দাম বাড়িয়েছে। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এখন পরিবর্তন চাই। দেশে যাতে আর কোনো গুম, খুন, রাহাজানি যেন না হয়। 

বানারীপাড়া বাইশারি থেকে সমাবেশে আসা একটি দলের সদস্য ছগির খান। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ অধিকার আদায়ের পথ খুঁজছেন। এখন বিএনপি’র সমাবেশের মধ্যদিয়ে সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন। এজন্য দলে দলে সভা- সমাবেশে মানুষের ঢল নামছে। আমার দাবি একটাই, এই সরকারের বিদায় চাই। যারা নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে রাখতে পারবে। দুর্নীতি রোধ করবে। দেশের ও জনগণের জন্য কাজ করবে। এমন সরকার গঠনের দাবিতে এই সমাবেশে যোগ দিয়েছি। 

মোস্তাফিজুর রহমান একটি সরকারি বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত। উজিরপুর থেকে শুক্রবার রাতে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে আয়োজিত বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশে আসেন। গণপরিবহন বন্ধ হওয়ায় আগের রাতেই আসতে হয়েছে তাকে। তিনি বলেন, সমাবেশে আসার একটাই উদ্দেশ্য। এই সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ। চাল, ডাল, তেল, লবণ- সবকিছুই আমাদের ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে চলে গেছে। এইজন্য খালেদা জিয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে এই সমাবেশে উপস্থিত হয়েছি। 

রফিকুজ্জামান লিটন নামের আরেকজন বলেন, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে দেশের মানুষ অস্থির হয়ে গেছে। গুম, খুন অব্যাহত রয়েছে। বিচার ব্যবস্থার দুরবস্থা। সারা দেশের প্রশাসনের মধ্যে দলীয়করণ চলছে। এর মধ্য দিয়ে দেশে কোনো সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এসব সম্মিলিত একটা দাবি বিএনপি’র মাধ্যমে আমরা দেশের মানুষকে জানাতে চাই। 

ট্রলারে করে ভোলার দৌলতখান থেকে বরিশালে বিএনপি’র সমাবেশে আসেন রাকিব পণ্ডিত। তিনি বলেন, আমি ৭/৮ বছর আগে ভোটার হয়েছি। এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচন একটি গেছে। এখনো ভোট দিতে পারিনি। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখি আমার ভোট অন্য একজন দিয়ে দিয়েছে। আমি ভোটের অধিকার চাই। দেশের গণতন্ত্র ফিরে পেতে চাই। শেখ হাসিনা ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়াবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে তিনি সেই প্রতিশ্রুতি রাখেননি।

এখন মোটা চালও ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে কিনে খেতে হচ্ছে। দিন দিন সবকিছুর দাম  বেড়ে নাগালের বাইরে চলে গেছে। পড়াশুনা শেষ করেছি। বেকার হয়ে পরিবারের বোঝা হয়ে দিনযাপন করছি। আমরা একটা পরিবর্তন চাই। 

ভোলার তজুমুদ্দিনের রিয়াজ উদ্দিন বলেন- আমি কৃষি কাজ করে খাই। বিগত কয়েক বছর ধরে সার- ওষুধের দাম বাড়ায় ঠিকমতো কিনতে পারছি না। সরকারের কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না। যারা আওয়ামী লীগ করে, মিছিল-মিটিংয়ে যায়, তারাই সরকারের দেয়া সার পায়। আগে বাজারে গেলে ব্যাগ ভর্তি করে বাজার করতাম। এখন ৫০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে চাল কিনলে ডাল কিনতে পারি না। তেল কিনতে পারি না। ছেলে-মেয়ের ভালো পোশাক দিতে পারছি না। সবকিছু লাগাম ছাড়া চলছে। 

রংপুরের বিএনপি’র সমাবেশে কাঁথা-বালিশ, চিঁড়া-মুড়ি নিয়ে এসেছিলেন আবুল খায়ের। নগরীর কালেক্টরেট ঈদগাহ্‌ মাঠে সমাবেশ। সমাবেশের আগের দিন পাশের ডায়াবেটিস সমিতি মাঠে বিছানা করে থাকেন তিনি। কখনো বসে, কখনো শুয়ে একাকী সময় কাটিয়েছেন। গল্পের ছলে সমাবেশে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন- বাজারে আগুন। দিন দিন অপরাধ বাড়ছে।

শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম বিপথগামী হচ্ছে। দলীয় লোকজন ছাড়া কেউ চাকরি পাচ্ছে না। পেতে হলেও ঘুষ লাগে। এসব আমরা চাই না। আমরা মুক্তি চাই। এজন্য বিএনপি’র সমাবেশে অংশ নিতে নানা বাধা পেরিয়ে হেঁটে হেঁটে লালমনিরহাট থেকে রংপুরে এসেছি। 

বাস ও লঞ্চ বন্ধ। বরিশালের কাউয়ার চরে নৌকা ঘাটে সরকার দলীয়  লোকজনের অবস্থান। সমাবেশে আসতে পারছেন না সফিজল হক। দুপুরে শুরু হয়েছে সমাবেশ। পরে ৫টি কলা গাছ কেটে ভেলা বানিয়েছেন তিনি। পলিথিনে অতিরিক্ত লুঙ্গি ও জামা নিয়ে স্রোতে ভেসে ভেসে কীর্তনখোলা নদী পার হয়ে সমাবেশে আসেন। নদীর পাড়ে পোশাক পাল্টিয়ে সমাবেশে যোগ দেন।

এতো কষ্ট করে সমাবেশে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৫ বছর আগে মাস্টার্স পাস করেছি। চাকরির জন্য সবরকম চেষ্টা করেছি। ঘুষ দিতে পারিনি বলে কোথাও চাকরি হয়নি। বৃদ্ধ বাবা মানুষের বাড়ি ও খেতে কাজ করে এখনো সংসার চালান। অথচ আমি পরিবারের বোঝা হয়ে আছি। কোথাও চাকরি হচ্ছে না। এখন বাবার কাজে সহযোগিতা করছি। দুইজনে যা আয় করি তা দিয়ে চলতে কষ্ট হয়। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এই দেশের প্রতিটি মানুষ আজ দিশাহারা। অনেকেই প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না। এখন আর চুপ থাকা যায় না। এই সরকারের পরিবর্তন চাই। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। সকল মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাক। এইজন্যই কলা গাছের ভেলা ভাসিয়ে স্র্রোতের মধ্যে নদী পাড়ি দিয়েছি- এটাই আমার প্রতিবাদ। 


মানবজমিন/ নভেম্বর ৮, ২০২২

মন্তব্য করুন