• , |
  • ঢাকা, বাংলাদেশ ।
সর্বশেষ নিউজ
* সংলাপের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করুন, যুদ্ধকে ‘না’ বলুন: শেখ হাসিনা * আপিল বিভাগের ৩ বিচারপতির শপথ সম্পন্ন * ‘হিট অ্যালার্ট’ এর মেয়াদ বাড়ল * গাজায় ইসরাইলি হামলায় আরো ৭৯ ফিলিস্তিনি নিহত * সিরিজের মাঝপথে পাকিস্তানের দুঃসংবাদ * মিয়ানমারের ২৮৮ বিজিপি ও সেনা সদস্যদের হস্তান্তর * তাপপ্রবাহে বাড়ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি, অনলাইন ক্লাস চালুর চিন্তা * রাঙ্গামাটিতে ডাম্প ট্রাক খাদে, নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৯ * হিজবুল্লাহ বনাম ইসরায়েল: বৃহত্তর যুদ্ধের সম্ভাবনা বাস্তব * মিয়ানমারের কারাগারে সাজা শেষে ফিরল ১৭৩ বাংলাদেশী

মূল্যস্ফীতি

বাজার সিন্ডিকেটের থাবা

news-details

ছবি-প্রতীকী


দেশের বাজার পরিস্থিতি একেবারে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়িরা নিজেদের ইচ্ছামত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে নিচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে জনদুর্ভোগ। অস্বাভাবিকভাবে ¦ালানীর মূল্যবৃদ্ধি করায় বাজারে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বেশ আগেই। সম্প্রতি লিটারে ¦ালানীর মূল্য আবার টাকা কমানো হয়েছে। প্রতিলিটারে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে টাকা কমানোকে জনগণের সাথে সরকারের রীতিমত ঠাট্টা-মশকরা বলেই মনে করছেন আত্মসচেতন মানুষ। কারণ, এতে বাজারে কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কোন সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে না। যদিও সরকার এর ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছে।

অপরদিকে বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বাজারে অস্থিরতা চলছে। তেল, আটা-ময়দা, মাছ-গোস্ত সবজিসহ একাধিক নিত্যপণ্য কিনতে ভোক্তা সাধারণের নাকাল অবস্থা। এর মধ্যে বেশি ভোগাচ্ছে কোনো কারণ ছাড়াই চালের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি। নেপথ্যে অবৈধ সিন্ডিকেটের থাবাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত এক মাসের ব্যবধানে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে -১২ টাকা। রাজধানীর খুচরা বাজারে এক কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে এখন ৫৮ টাকায়। পাশাপাশি ভালোমানের সরু চাল বিক্রি হয়েছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। এতে সকল শ্রেণির ক্রেতারই নাভিশ্বাস উঠেছে। বিশেষ করে অসহনীয় কষ্ট পোহাচ্ছে নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষ। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে একেবারেই ভাবলেশহীন। মনে হয় বিষয়ে তাদের কিছুই করণীয় নেই।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক পণ্যমূল্য তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিকেজি মোটা চাল এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ। মাঝারি আকারের চালের দাম মাস বছরের ব্যবধানে দশমিক ৪৯ শতাংশ বেড়েছে। আর মাসের ব্যবধানে সরু চালের দাম দশমিক ৩২ শতাংশ বছরের ব্যবধানে ১৩ দশমিক ২৮ শতাংশ বেড়েছে। এর আগে কখনোই চালের দাম এভাবে বৃদ্ধির রেকর্ড নেই।

এজন্য অসাধু ব্যবসায়িদের কারসাজীকেই দায়ি করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এরা মাঝে মধ্যেই এক একটি পণ্যকে টার্গেট করে এর দাম বাড়াচ্ছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় এমন সব পণ্যের দামই তারা বেশি করে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর আগে সয়াবিন তেল ডিমের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন তাদের নজর পড়েছে চালের বাজারে। সরকারের পক্ষ থেকে খুচরা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও সিন্ডিকেটের মূল নায়কদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে না। ফলে তারা রীতিমত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মূলত, সরকারের রহস্যজনক উদাসীনতা নির্লিপ্ততার কারণেই চালের বাজার পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতি ঘটেছে। এর সবচেয়ে বড় ভিকটিম প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ।

অবশ্য সরকার পক্ষ দাবি করছে তারা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বিষয়ে সরকারের একাধিক সংস্থা বাজার সিন্ডিকেটের হোতাদের তালিকা করে উচ্চ পর্যায়ে জমা দেয়া হয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাজারে কোন ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি।  যদিও সরকারি সূত্র বলছে, বর্তমানে চাহিদার চেয়ে চালের মজুত সরবরাহ বেশি রয়েছে। এছাড়া চালের দাম এত বেশি মাত্রায় বাড়ার মতো কোনো যৌক্তিক কারণও তারা দেখছেন না। কেবল গত আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে প্রতি কেজিতে সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা বাড়তে পারে। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর প্রতি কেজিতে থেকে টাকা বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আগে থেকেই চালের দাম কোনো কারণ ছাড়াই লাগামহীনভাবে বেড়ে আসছিল। গত এক মাসের ব্যবধানে গড়ে চালের দাম থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যা শুধু অনাকাক্সিক্ষতই নয় বরং অযৌক্তিকও।

এদিকে চালের দাম কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আমদানি ব্যয় কমাতে গত ২৪ জুন করহার ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। তারপরও চাল আমদানীতে কোন গতি নেই। খাদ্য অধিদপ্তরের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন বলছে, গত জুলাই থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৩২ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।

মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবসময়ই আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দেয়া হলেও বৈদেশিক বাজারে কিন্তু চালের দাম এখন নি¤œমুখী। কিন্তু তারপরও আমাদের দেশে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েই চলেছে। জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি বিষয়ক সংস্থার (ফাও) তথ্য মতে, ২০২২ সালের মার্চে খাদ্য খাতের সূচক বেড়ে সর্বোচ্চ ১৫৯ দশমিক পয়েন্টে দাঁড়ায়। এরপর থেকে কমতে থাকে। এপ্রিলে সামান্য কমে ১৫৮ দশমিক পয়েন্ট, মে মাসে আরও কিছুটা কমে ১৫৭ দশমিক পয়েন্ট হয়। জুনে তা আরও কমে ১৫৪ দশমিক পয়েন্ট, জুলাইয়ে তা আরও কমে ১৪০ দশমিক পয়েন্টে দাঁড়ায়। কিন্তু দেশে চালের দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। যদিও আমাদের দেশের চালের বাজার আমদানিনির্ভর নয়। মানুষ মোট ব্যয়ের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি খাদ্যখাতে ব্যয় করে। এরমধ্যে স্বল্প মধ্যম আয়ের মানুষের চাল কিনতেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। যে কারণে চালের দাম বাড়লে এসব মানুষের ভোগান্তিও বেশি বাড়ে।

চালের  মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে রাইস এজেন্সিগুলো বলছে, দেড় মাস আগে মিলারদের কারসাজিতে চালের দাম বাড়তে শুরু করলে সরকারের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু ডলারের দাম বাড়ায় ভারত থেকে আমদানি করা চালের দাম দেশের চালের তুলনায় বেশি। তাই মিলাররা আবারও সে সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। আমদানি করা চালের সঙ্গে সমন্বয় রেখে মিল পর্যায় থেকে দেশি চালের দামও কেজিতে - টাকা বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর পরিবহণ খরচ বাড়ার অজুহাতে মিল পর্যায়ে প্রতিকেজি চালের দাম আরও টাকা বেড়েছে। সঙ্গত কারণেই পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম বেড়ে গেছে। পরিবহণ খরচের কারণে চালের দাম বাড়লে এজেন্সীগুলোরই বাড়ানোর কথা। কিন্তু মিলাররা কীভাবে পরিবহণ খরচের দোহাই দিয়ে চালের দাম বাড়াচ্ছে তা কারো কাছেই বোধগম্য হচ্ছে না।

বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)এর বক্তব্য হলো, ‘যেভাবে চালের দাম বাড়ছে তাতে পরিবারের একজনের আয়ের অর্ধেকের বেশি টাকা চাল কিনতেই খরচ হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি অন্যসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। সব মিলিয়ে মানুষের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে; আয়ের সঙ্গে ব্যয় সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই এখনই গঠনমূলক পদক্ষেপ নেয়ার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে।

সম্প্রতি চালের বাজারে কারসাজি সিন্ডিকেটের কথা স্বীকার করে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় চালের মূল্য প্রতি কেজিতে সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা বাড়তে পারে। কিন্তু কেজিতে ইতোমধ্যে দাম বেড়েছে টাকা তিনি মনে করেন, কেজিতে এত টাকা দাম বাড়ার কোনো যুক্তি নেই।  কিন্তু তার উষ্মা প্রকাশের মাধ্যমেই সরকার বা তার মন্ত্রণালয়ের দায় শেষ হয় না বরং বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে।।

বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বক্তব্য বেশ চমকপ্রদ। অধিদপ্তর মনে করে, একটি ট্রাকে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কেজি সবজি পরিবহণ করা হয়। এখানে তেলের দাম বাড়ার পর ভাড়া কেজিপ্রতি এক টাকা বেশি লাগতে পারে। ৪০ টাকার সবজি সেখানে ৬০ টাকা হওয়ার কথা নয়। পাশাপাশি চাল পরিবহণে আরও কম খরচ পড়ে। এক ট্রাকে দশ থেকে ১৫ টন করে চাল পরিবহণ করা হয়। এখানে পাঁচ হাজার টাকা অতিরিক্ত ভাড়া লাগলে প্রতি কেজিতে ৩৩ পয়সা বাড়তি খরচ হয়। দশ টনে ৫০ পয়সা বেশি খরচ হওয়ার কথা। কিন্তু ¦ালানীর মূল্যবৃদ্ধিকে অজুহাত বানিয়ে একটি মহল অযৌক্তিকভাবে চাল সহ নিত্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করেছে। এমতাবস্থায় চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। চাল মজুত করে ব্যবসায়ীরা বেশি দরে বিক্রি করছেন-এমন প্রমাণও মিলেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন অনিয়মের কারণে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। অসাধুদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দাবির কোন প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফলে বাজারে শৃঙ্খলাও ফিরছে না।

মূলত, বোরো মৌসুমজুড়ে ধান-চালের কোনো সঙ্কট দেখা দেয়নি। একই সঙ্গে সরবরাহ ব্যবস্থাও পুরোপুরি স্বাভাবিক ছিল। এরপরও পুরো মৌসুমে চালের বাজার অস্থিতিশীল ছিল। মৌসুমের শুরুতে যে মিনিকেট চালের দাম ছিল ৫৫-৫৬ টাকা, তা এখন ঠেকেছে ৬৫ টাকায়। চালকল মালিকরা দাবি করছেন, তারা চালের দাম বাড়ান নি। ধানের দাম বাড়ায় চাল উৎপাদনের ব্যয় বেড়েছে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম বাড়তি। তাই চাল ছাঁটাইয়ের খরচও বেড়েছে। সব মিলে চালের দাম বেড়েছে।

দেশের প্রত্যন্ত জেলাগুলো থেকেও একই ধরনের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন জেলা খাদ্যে উদ্বৃত্ত হলেও চালের দাম বৃদ্ধি রোধ করা যাচ্ছে না। ধানের দামের তুলনায় চালের দাম অস্বাভাবিক বেশি। আবার পাইকারি থেকে খুচরা বাজারেও দামের অস্বাভাবিক তফাৎ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ধান চাল কমপক্ষে তিনটি হাতবদল হচ্ছে। এতে কৃষকরা লাভবান না হলেও মিলার মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হচ্ছেন। আর জনজীবনের পড়ছে তার বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব।

শুধু আমাদের দেশে নয় সারা বিশে^ মূল্যস্ফীতি ঘটছে। কিন্তু বিশে^ বিভিন্ন দেশে তা নিয়ন্ত্রিত যৌক্তিক পর্যায়ে থাকলেও আমাদের দেশের চিত্রতা শুধু ভিন্নতরই নয় বরং রীতিমত আতঙ্কের। আর এক্ষেত্রে বাজার সিÐিকেটের কালো থাবা পড়েছে অত্যবশ্যকীয় পণ্য চালের ওপর। ফলে এই পণ্যটির মূল্য প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নি¤œমুখী হলেও লাগামহীন মূল্যস্ফীতি জনমনে রীতিমত আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। এমতাবস্থায় চালসহ নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা না গেলে পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। আর দায় সরকার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোন ভাবেই এড়াতে পারে না।

 

 

 


সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

মন্তব্য করুন