• , |
  • ঢাকা, বাংলাদেশ ।
সর্বশেষ নিউজ
* জলদস্যুদের সাথে ২৩ নাবিকের মুক্তিপণের বিষয়ে এখনো কথা হয়নি: কবির গ্রুপ * ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের * গাজায় থামছেনা ইসরায়েলি বর্বরতা, নিহত আরও ৬২ ফিলিস্তিনি * প্রতিদ্বন্দিতা ছেড়ে ব্যবসায় হাত মেলালেন আম্বানি-আদানি * সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা * ভারতে কারাগারে মুসলিম রাজনীতিবিদের মৃত্যু : ছেলের অভিযোগ বিষপ্রয়োগ * কারাবন্দী বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র * গাজীপুরে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে ২ যুবক নিহত * তিন শিশুর মৃত্যুরহস্য : অ্যানেসথেসিয়ার ওষুধেও ভেজাল * শিক্ষার্থী বেড়েছে কারিগরি ও মাদ্রাসায়, কমেছে মাধ্যমিকে

মানবাধিকার

গণতন্ত্র মানবাধিকার ও আধুনিক রাষ্ট্র

news-details

ছবি-প্রতীকী


গণমানুষের কল্যাণকামীতার অংশ হিসাবেই আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। তবে সম্প্রতিককালে রাষ্ট্রচিন্তায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্র বিষয়ক মৌলিক ধারণাগুলোর ব্যাখ্যা পরিশীলিত হচ্ছে; এসেছে অভিনবত্বও। ফলে রাষ্ট্রের (State)  পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা (Political system)  শব্দটি। রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংজ্ঞা দিয়ে ডেভিড ইস্টন (David Easton) বলেছেন, ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো লক্ষ্য স্থির, নিজেকে রূপান্তরিত করার ও পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধানের এক সৃজনশীল ব্যবস্থা(A goal setting, self-transforming and creatively adaptive system.)। রাজনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্য হলো ‘সমাজে উপযোগের প্রভূত্বব্যঞ্জক বরাদ্দ (The authoritative allocation of values).

অবশ্য গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড (G A Almond) রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংজ্ঞা দিয়েছেন ভিন্ন আঙ্গিকে ও চমকপ্রদভাবে। তার মতে, ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো এমন একটি পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যা প্রত্যেকটি স্বাধীন সমাজে বিদ্যমান; যেখানে বৈধ উপায়ে কমবেশি বল প্রয়োগ করে বা বল প্রয়োগের ভয় দেখিয়ে অভ্যন্তরীণ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সংহতি সাধন ও নায্যতায় অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয়াদি নিষ্পন্ন করা হয়। মূলত, রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো, একটি বৈধ, শৃঙ্খলারক্ষাকারী ও রূপান্তর সাধনকারী ব্যবস্থা। তবে এক রূঢ় বাস্তবতায় আমাদের দেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ, স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতালিপ্সা। সঙ্গত, কারণেই অনিয়মই এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ফলে আমাদের প্রচলিত রাজনীতি গণমানুষের জন্য পুরোপুরি কল্যাণকর হয়ে ওঠেনি; বরং এক্ষেত্রে রয়েছে বড় ধরনের বিচ্যুতি। রাষ্ট্রও নাগরিকদের জন্য কল্যাণমুখী হয়ে উঠতে পারেনি। যা আমাদের স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধের সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

বস্তুত, নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হলেও রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে বা ক্ষেত্র বিশেষে উদাসীন থাকছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রায় ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক শক্তিগুলো জনস্বার্থের পরিবর্তে অনৈতিকভাবে আত্মস্বার্থ ও ক্ষমতা চর্চার অশুভ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি রীতিমত চোখে পড়ার মত। জনজীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের হলেও জনগণ রাষ্ট্রের সে সেবা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশ ও জাতিকে যেভাবে প্রস্তুত করা দরকার ছিল সেখানেও ব্যর্থতার ছাপটা সুস্পষ্ট। ফলে স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরেও আমরা প্রায় সকল ক্ষেত্রেই পশ্চাদপদই রয়ে গেছি।

রাষ্ট্রের পৌণপৌণিক ব্যর্থতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি ও সুশাসনের অভাবেই আমাদের এই জাতীয় বিপর্যয়ের জন্য প্রধানত দায়ী বলে মনে করা হয়। ফলে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। নিকট অতীতে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- অপ্রতিরোধ্যই ছিল। কতিপয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর অবশ্য এ প্রবণতা খানিকটা কমে এসেছে। তবে গায়েবি ও ভিত্তিহীন মামলা এবং অনাকাক্সিক্ষত গ্রেফতার প্রবণতা আগের তুলনায় বেড়েছে। নিকট অতীতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের পর নিহতদের কুখ্যাত, ভয়ঙ্কর অপরাধী কিংবা ডাকাত দলের সর্দার তকমা দেয়া হতো আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে। অভিযোগ রয়েছে সব কিছুই ঘটছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। অথচ আমাদের দেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসবের প্রতিফলন যৎসামান্যই।

সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, The Republic shall be a democracy in which fundamental human rights and freedoms and respect for the dignity and worth of the human person shall be guaranteed. অর্থাৎ প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে

সংবিধান অনুসরণ করে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাসহ নাগরিকের সকল অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সরকার সে দায়িত্ব পালনে কতখানি সক্ষম বা আন্তরিক তা নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। সারাদেশেই মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গুম ও অপহরণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। চলছে রাজনৈতিক নিপীড়নের মহোৎসব। বিরোধী দলের ঘরোয়া বৈঠকগুলোকে গোপন বৈঠক আখ্যা দিয়ে নেতাকর্মীদের গণহারে কথিত রিমান্ডের নামে নির্যাতন চালানোর অভিযোগও বেশ জোড়ালো। রাজপথেও বিরোধী দলগুলো নির্বিঘেœ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারছে না। এমনকি ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ করার জোরালো অভিযোগও উঠেছে সম্প্রতি। সে ধারাবাহিকতায় গত ২৭ মার্চ রাতে রাজধানীর গুলশানের সাহজাদপুরের সুবাস্তু মার্কেট সংলগ্ন একটি কুরআন শিক্ষা কেন্দ্র থেকে তারাবীহ নামাজরত অবস্থায় ইমামসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছে গুলশান থানা পুলিশ। এদের মধ্যে এক শিশুসহ ২ জন নারী এবং তিনজন হাফেজও রয়েছেন। এদের মধ্যে দু-একদিনের মধ্যে ওমরা হজ্ব করতে যাবেন এমন মুসল্লিও রয়েছেন বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধান সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, ইসলামিক এন্টারপ্রাইজ বা কুরআন শিক্ষা কেন্দ্রটি দীর্ঘ পাঁচ বছর থেকে স্থানীয় জনগণ পরিচালনা করে আসছেন। এখানে বয়স্কদের কুরআন শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি বছর পবিত্র রমযান মাসে পুরুষ ও নারীদের তারাবীহ নামায আদায় করে থাকেন। এছাড়া বয়স্করা সহীহ কুরআন শিক্ষা গ্রহণ করেন। সেন্টারটিতে কুরআন, হাদীস ও নামাজ শিক্ষা বই সহ বিভিন্ন মাসয়ালা মাসায়েলের বইও বিক্রি করা হয়। এলাকার সর্বস্তরে মানুষ এই কেন্দ্রের সাথে সম্পৃক্ত। যা ধর্মীয় স্বাধীনতার মারাত্মক লঙ্ঘন বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল। কারণ, সংবিধানের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২(ক)-এ বলা হয়েছে, The state religion of the republic is Islam, But the state ensure equal status and equal right in the practice of Hindu, Buddhist, Christian and other religions. অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মপালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমমর্যাদা নিশ্চিত করিবেন।

আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বড় ধরনের প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি অভ্যন্তরীণ বৃত্ত পেড়িয়ে এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও স্থান করে নিয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচনটিতে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরানো, বিরোধী দলের প্রার্থীদের এজেন্ট এবং ভোটারদের ভয় দেখানোসহ নানা অনিয়মের খবরে পর্যবেক্ষকেরা এ ধারণা করেন। গত ২০ মার্চ ‘২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস শীর্ষক এক প্রতিবেদনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশ অংশে বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ বেআইনি বা নির্বিচারে হত্যা, গুম, নির্যাতন, কারাগারের অবস্থা, নির্বিচারে গ্রেফতার বা আটক, রাজনৈতিক বন্দী, কোনো ব্যক্তির অপরাধের জন্য পরিবারের সদস্যদের শাস্তি, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা সহিংসতার হুমকি, সাংবাদিকদের অযৌক্তিকভাবে গ্রেফতার বা বিচার, মতপ্রকাশ সীমিত করার জন্য ফৌজদারি মানহানি আইন কার্যকর, স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং মিডিয়ার ওপর বিধিনিষেধ, ইন্টারনেট স্বাধীনতার ওপর নিষেধাজ্ঞা; শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের মতো বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির কথা রয়েছে; যেখানে অধিকাংশ ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত। এতে আরো বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের বিরুদ্ধে বহু নির্যাতনের ঘটনা ঘটানোর অভিযোগ রয়েছে। নির্যাতন ও দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যাপকভাবে দায়মুক্তি দেয়ার অনেক খবর রয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন বা দুর্নীতিতে জড়িত কর্মকর্তা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চিহ্নিত করা, ঘটনার তদন্ত করা, তাদের বিচার ও সাজা প্রদানে হাতে গোনা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এদিকে এই প্রতিবেদন নিয়ে এক বিবৃতিতে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, ‘ব্যক্তির অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন একটি অধিকতর নিরাপদ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধশালী বিশ্ব গড়ে তুলতে সহায়তা করে। (মানুষের) মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করার মধ্য দিয়ে দেশ হিসেবে আমাদের পরিচিতির মূল দিকটি ফুটে উঠে।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) ৫০টি আসনে জরিপ করে নির্বাচনকে ‘অভূতপূর্ব ও ‘অবিশ্বাস্য বলে অভিহিত করেছিল। টিআইবি ৪৭টি সুনির্দিষ্ট অনিয়ম চিহ্নিত করেছে, যার মধ্যে রয়েছে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল দেয়া, প্রতিপক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশের সুযোগ না দেওয়া। অনেক ভোটারের ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না পারা, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারা, জোর করে নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করা, ভোট শুরুর আগে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা, ভোট শেষের আগে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া, গণমাধ্যমের জন্য ‘অভূতপূর্ব কঠোর নিয়ন্ত্রণের অভিযোগও করা হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে। যা আমাদের দেশের ভঙ্গুর গণতন্ত্রের দিকেই অঙ্গলি নির্দেশ করে। কিন্তু অবস্থা থেকে আমরা উত্তরণের চেষ্টা করছি না। আগামীতে কীভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে তা নিয়ে ক্ষমতাসীনদের কোন মাথাব্যথা নেই। বিষয়টি নিয়ে বিরোধী দলগুলো বেশ সোচ্চার হলেও রাজনৈতিক সমঝোতার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না বরং সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতরই হচ্ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে গুম ও অপহরণের প্রবণতাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বিষয়টি নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে বিভিন্নভাবে প্রশ্ন তোলার পরও পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। মূলত, গুম বা অপহরণ উভয়টিই গুরতর ফৌজদারি অপরাধ। সরকার পক্ষে অবশ্য এসব ঘটনাকে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ বলে দাবি করা হয়েছে বা এখনও হচ্ছে। কিন্তু কেউ স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হলে তাদেরকে খুঁজে বের করার দায়িত্বও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। ভিকটিমের পরিবারকে তার স্বজনের অবস্থানের বিষয়ে জানানোর দায়িত্ব রাষ্ট্র কোনভাবেই এড়াতে পারে না। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের নির্লিপ্ততা জনমনের সন্দেহ-সংশয়কে আরও জোরালো করেছে।

মূলত, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর তা করতে হবে সম্পূর্ণ আইনানুগ ও সাংবিধানিক পন্থায়। কিন্তু এভাবে হত্যা, গুম ও অপহরণ করে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সমাধান করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, অপরাধী ভয়ঙ্করই হোক আইনী আশ্রয় ও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার সকলেরই আছে। আর এ অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদানের দায়িত্বও রাষ্ট্রের। কিন্তু বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী না করে এভাবে মনবাধিকার লঙ্ঘনের মহড়া কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বরং তা রাষ্ট্রের কার্যকারিতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

মূলত, চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘন, গায়েবি মামলা, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গুম, অপহরণ ও গুপ্তহত্যা বন্ধ করতে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে উদাসীনতার অভিযোগটাও বেশ জোরালো। এসব বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগও কম নয়। অথচ সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাগরিকের নিরাপত্তাসহ সকল অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। সরকার একদিকে যেমন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করতে পারছে না। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকেরই জীবন-ধারণ, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। অনুচ্ছেদ ৭ এ বলা হয়েছে, ‘আইনের কাছে সকলেরই সমান এবং কোনরূপ বৈষম্য ব্যতিরেকে সকলেরই আইনের দ্বারা সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। এই ঘোষণাপত্রের লঙ্ঘনজনিত বৈষম্য বা এরূপ বৈষম্যের উস্কানির বিরুদ্ধে সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার সকলেরই আছে

যেকোন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সাময়িক সুবিধা অর্জন করা গেলেও তা কোন সুদূরপ্রসারী ফল বয়ে আনে না বরং প্রতিহিংসা জন্ম দেয়। তাই যেকোন সমস্যা সমাধানে সরকারকে বুদ্ধিদীপ্ত ও দূরদর্শী হওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। জনগণও সরকারের কাছে এসব বিষয়ে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করছে।

মূলত, প্রত্যেক মানুষের রয়েছে স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা, ভোট প্রদান, চিন্তার ও বাক-স্বাধীনতার অধিকার। প্রতিটি মানুষেই চায় সামাজিক নিরাপত্তা, বিশ্রাম, বিনোদন ও চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে কর্মসৃষ্টি, কর্মের অনুকূল পরিবেশ ও উপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভের অধিকার। ভোটের অধিকার, রাজনীতি করার অধিকার, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অধিকারসহ নানাবিধ মৌলিক অধিকারই একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য মানবাধিকার। রাষ্ট্র থাকলে নাগরিক থাকবে, রাজনীতি ও রাজনীতিক থাকবে, সরকার গঠনের পদ্ধতি থাকবে, মতবাদ থাকবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে; রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা সম্পর্কিত এসব বিষয়ে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ থাকবে। মানুষ স্বাধীনভাবে যার যার অবস্থান থেকে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে। এসব করতে পারার নাম গণতন্ত্র।

আধুনিক রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি হচ্ছে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি উদাসীন হওয়ার কারণে রাশিয়া ভেঙে গেছে। একই কারণে বহু নগররাষ্ট্র ব্রিটিশদের হাতছাড়া হয়েছে। বর্তমান বিশ্বেও মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের মর্যাদা সমুন্নত না থাকায় বিশ্বপরিস্থিতিও আজ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। চোখের সামনে মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল ভূখন্ড মানবাধিকারহীন অগণতান্ত্রিক হিংসার আগুনে পুড়ে ছাই হতে চলেছে। এ ছাড়াও তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো গণতন্ত্রহীন স্বৈরশাসনের কবলে পড়ে প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসবাদের চক্রান্তে জড়িয়ে যাচ্ছে। যা বিশ্ব পরিস্থিতিকে ক্রমেই আশান্ত ও অস্থির করে তুলছে।

মূলত, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে নাগরিকদের সকল ধরনের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা। বস্তুত মানবাধিকার ও গণতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক।  কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় গণতন্ত্র হরণ ও গণমানুষের অধিকার ক্ষুণেœর অভিযোগটা বেশ জোরালো। সঙ্গত কারণেই আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো এখনও বেশ ভঙ্গুর। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও বিকশিত হয়নি আমাদের দেশে। মানবাধিকারের বিষয়টিও এখনও প্রশ্নবিদ্ধই রয়ে গেছে। তাই রাষ্ট্রও পুরোপুরি সফল হয়ে ওঠেনি। যা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত!


সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

মন্তব্য করুন