ছবি: এনএনবিডি
আমরা সহসাই সভ্য বলে দাবি করি। কালের পরিক্রমায় কত কিছুই না পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবর্তনটা কোন ক্ষেত্রেই এমনি হয়নি। অনেক পোড় ক্ষেতে হয়েছে কিংবা ত্যাগের নজির স্থাপন করতে হয়েছে। ক্ষেত্রভেদে পরিবর্তনের গল্পটাও ভিন্ন ভিন্ন আবেশে উপস্থাপিত হয়েছে। এর কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরলে সভ্যতার বির্বতন বা দ্বান্দিক চিত্র বোঝা সহজ হবে। আমরা সাধারণত ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই লড়াই করে বাঁচতে চাই’- এমন উত্তেজনা পূর্ণ শ্লোগানে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনগুলো মুখর থাকতে দেখে অভ্যস্ত। কখনো দাবি আদায়ে কখনোবা অধিকার বঞ্চিত হওয়ার প্রতিবাদে মাঠ কাঁপিয়ে তোলে শিক্ষার্থীরা। শুধু ক্যাম্পাস নয় এমনিভাবে রাজপথও থাকে সাধারণ প্রতিবাদীদের দখলে। এসবের নেতৃত্বেই থাকেন উচ্চ শিক্ষিতরা।
দাবির যৌক্তিকা কিংবা নিজ স্বার্থ রক্ষায়ও এসব শ্লোগানের তীব্রতাও দেখা যায়। দাবি আদায় করতে গিয়ে যে অন্যের অধিকার, নিরাপত্তাও কখনো কখনো উপেক্ষিত হয় সেদিকে হয়তো ভ্রুক্ষেপ করা হয় না। এরূপ একটি প্রবাহ সব কিছু আমাদের ভুলিয়ে দেয়। আমরা সামগ্রিকতার বিবেচনায় না থেকে সম্মুখ উপস্থিত বিষয়ে বেশি আগ্রহী থাকি। যেকারণে বৃহৎ অনেক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। যেমনটি ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র হতাহতের ঘটনা আমাদেরকে আজও দেখতে হচ্ছে। সুস্থধারার পূর্ণ শিক্ষার পরিবেশের ক্যাম্পাস বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চিত করতে পারছে না। যা সকলের জন্য উদ্বেগের। কোথাও র্যাগিং, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, হত্যা, টেন্ডারবাজি, সংঘর্ষ ইত্যাদি। এসব কি সভ্য সমাজের উপাদান? না সভ্য হয়ে ওঠার জন্য এসব করতে হয়? তার যদি কোনটিই প্রাসঙ্গিক না হয় তাহলে এসবের অবতারণা হয় কিভাবে? সে প্রশ্নের উত্তর তো খোঁজার কথা ছিল। তা আজও অস্পষ্টতায় নিমজ্জিত।
দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনগুলোতে গবেষণা, আবিস্কার উদ্ভাবন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় ভূমিকা রাখার কথা। সামাজিক, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতি নৈতিকতার বিকাশ সাধনের পাঠ ও অনুশীলনের সর্বোচ্চ স্থান হওয়ার কথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কিন্তু সেই ক্যাম্পাস এখন সকলের জন্য আতঙ্কের নাম। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা সর্বদা থাকেন শঙ্কিত।
চলতি ২০২৩ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি সারাদেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিভাবে একজন ছাত্রীকে নির্যাতন করা হয়েছে। শেষমেষ দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায় বিষয়টি। বহিস্কারের ঘটনাও ঘটে। এতো কেবল হেনস্তার বিষয় হত্যার ঘটনাও কম নয়। কত স্বপ্নের যে মৃত্যু হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
গত দুই-তিন দিন ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষের বিষয়টির দিকে সবার নজর। যে ঘটনাকে সংঘর্ষের সূত্রপাত তা এত বড় ঘটনায় গড়ানোর মতো নয়। স্থানীয় বা বাসের স্টাফের সঙ্গে ছাত্রদের এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায় এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে বাসের স্টাফের বাকবিতণ্ডার জেরে এটির শুরু হয়েছে।
সর্বশেষ আজ সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুইদিন ক্যাম্পাসের কার্যক্রম বন্ধ রাখার পর আগামীকাল থেকে আবার সবকিছু স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিয়েছেন। পরীক্ষা, ক্লাস যথারীতি চালাবেন। প্রশ্ন হলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এরূপ ঘটনা যে আর ঘটবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে? বা এসবের সমাধানে বা পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে। সেই ব্যবস্থা কি নেয়া হয়েছে। হয়তো সাময়িক কোন সমাধান এটি। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে যতটুকু জানা যায় যে ঘটনার মূলে রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করেছে। এখানে পরবর্তীতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে। তাই যদি হয় তাহলে এরূপ ঘটনার সমাধান সহজ হবে না। ঘটনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বহিরাগতদের দায়ী করছেন।
ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে কয়েকটি বিষয়ে নজরে নেয়া যেতে পারে- সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী হিসেবে বিষয়টি কেন নমনীয় করতে পারলেন না শিক্ষার্থীরা। সহনশীলতার পরিচয়ও বা কেন দিলেন না উভয় পক্ষ। কেন প্রতিশোধ পরায়ণতার দিকে ঝুঁকলেন উভয় পক্ষ। সংঘর্ষ এতো বড় রূপ নেয়ার সুযোগ দিলেন কেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ, কিংবা স্থানীয় দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। সংকট সমাধানের পথকে জটিল করে দীর্ঘ রূপ দিলেনই বা কেন। এরকম অসংখ্য প্রশ্ন তোলা যাবে। যার কোনো সদুত্তর পাওয়া যাবে না।
এসব ঘটনার পূর্বাচর বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কয়েকটি জিনিসের সংকট তা হলো-আমরা পরমত সহিষ্ণতার মানসিকতা ধারণ করি না বা সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারিনি আজও। অন্যের অধিকারকে শ্রদ্ধা করি না বা তা সংরক্ষণে যে মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের দায় আছে তা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রতিফলনের পরিবেশ দেয়া হয়নি প্রজন্মকে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণই এখন শিক্ষিতদের হাতে। অথচ তা আজ দ্বান্দ্বিক চরিত্রে রূপ নিয়েছে। যা শিক্ষিতিদের আত্মদ্বন্দ্বও বলা যেতে পারে। সকল ক্ষেত্রে অর্জনই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় অন্যের অধিকারকে হরণ করা বৈধতা দেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষকে চালিত বস্তুর ন্যায় ব্যবহার করার মানসিকতাও তৈরি হয়েছে নেতৃত্বের। এমনি পরিস্থিতিতে সভ্যতার উৎকর্ষতার মোড়কে সংকটের ফাঁদে পড়বে বলেই মনে হচ্ছে। বাহ্যিক চাকচিক্য থাকলেও তা মানবজাতির কল্যাণের পরিবর্তে ক্ষয়িষ্ণুতার বাহক হবে।
আবু জায়েদ আনসারী
মন্তব্য করুন