সংগৃহীত
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যেভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে চিত্র বাংলাদেশে অনেক বছর দেখা যায়নি। নানা কারণে এই নির্বাচনের একটা বাড়তি গুরুত্ব আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর দাপট এবং তাদের নির্বাচনে জেতানোর জন্য প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে তৎপর হয়ে উঠতো, সে চিত্র গাজীপুরে ছিল না। অনেকের ধারণা, নির্বাচনের ঠিক আগের রাতে আমেরিকা নতুন যে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, সেটির প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে কিছু ক্ষেত্রে এজেন্টদের গোপনে হুমকি দেয়ার অভিযোগ আসলেও বড় পরিসরে কোনো সহিংসতা বা অপ্রীতিকর ঘটনার কথা শোনা যায়নি। আওয়ামী লীগের বিপরীতে জিতেছেন এমন একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী - যাকে রাজনীতিতে সরাসরি কেউ চিনতো না।
তাহলে গাজীপুর নির্বাচন ও এর ফলাফল সামনের নির্বাচনের ক্ষেত্রে কি কোনো প্রভাব ফেলতে পারে?
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও আমেরিকার ভিসা নীতি:
বিজয়ী জায়েদা খাতুনের পরিচয় মূলত সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা হিসেবে। জাহাঙ্গীর আলম আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এক বিতর্কিত মন্তব্য ফাঁসের জেরে।
তিনি নিজে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও জয়ী হয়ে এসেছেন তাঁর মা যিনি রাজনীতিতে ছিলেন একেবারে অপরিচিত এক মুখ।
বিশ্লেষকদের মতে অন্তত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অনেকটাই 'লেভেল প্লেইং ফিল্ড' দেখা গেছে।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করলেও আওয়ামী লীগের পার্থীর হারকে অনেকটাই গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। যেমন লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহীউদ্দীন আহমদের মতে এখানে আমেরিকার নতুন ভিসা নীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে, নয়তো চিত্রটা ভিন্নও হতে পারতো।
আমেরিকার চাপ অব্যাহত থাকলে এর পরবর্তীতেও হয়তো প্রশাসন বা রাজনীতিবিদেরা আরো সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নেবেন এমন কথাই উঠে আসছে।
“যারা এক পা দিয়ে রেখেছে আমেরিকায় - তাদের কাছে আমেরিকা তো বেহেশত। বেহেশত ছেড়ে পার্টিকুলার দলের লোককে জেতানোর জন্য কেন ঝুঁকি নেবে?” এমন মন্তব্য করেন মিঃ আহমদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী মনে করেন, এই নির্বাচন নিয়ে সব পক্ষই সন্তুষ্ট এবং এটা একটা ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে যে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে সচেষ্ট।
আমেরিকার নতুন ভিসা নীতির প্রভাব নিয়ে মিঃ চক্রবর্তী বলেন, “যারা নির্বাচনের সময় অতি উৎসাহী হয়ে নির্বাচনের আগে বা পরে কিছু করার চেষ্টা করেছেন তারা হয়তো সেটা থেকে একটু বিরত থাকবে”।
আমেরিকার নতুন ভিসা নীতি গাজীপুর নির্বাচনের পরিবেশ বদলে দিয়েছে - বলছেন লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহীউদ্দীন আহমদ
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলছেন, বিএনপির জন্য এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কোনো লেভেল প্লেইং ফিল্ড সৃষ্টি হয়নি কারণ তাঁদের মতে নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে আস্থা রাখা সম্ভব না।
কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন যে এর আগেও এমন স্থানীয় নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জয় পেয়েছিল, কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত আস্থা রাখার মতো কোনো পরিস্থিতি দেখা যায়নি।
তবে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট আমেরিকার ভিসা নীতি কি বিএনপিকে আশ্বস্ত করতে পারছে না? এদিক দিয়ে মিঃ চৌধুরীর মত হলো - এতে করে হয়তো ‘অনেকগুলা মানুষের জীবন বেঁচে যাবে’ যেমনটা এর আগে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে হয়েছিল, কিন্তু তাতে করে ‘ভোটচুরির প্রকল্প’ পরিবর্তন হয়ে যায়নি।
আস্থাভাজন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে না বলেই মনে করছে বিএনপি।
অর্থাৎ নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপির অবস্থানের নীতিগত কোনো পরিবর্তন এখনো দেখা যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ কৌশল পাল্টাবে?
ভুলভ্রান্তি সনাক্ত করে সাবধানী পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছেন কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক
গাজীপুর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোঃ আজমত উল্লা খানের হার হলেও আওয়ামী লীগ মনে করছে - এটি দলের জন্য একদিক থেকে ভালো, কারণ এর মধ্য দিয়ে এমন একটি দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে যে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ আছে।
কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সরকারের কাজ নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সহায়তা দেয়া, যে লক্ষ্য অর্জন হয়েছে।
“এই যে ফলাফল এসেছে তাতে আওয়ামী লীগের কোনো ক্ষতি হবেনা। বরং আওয়ামী লীগ আমরা, সরকার লাভবান হবে,” - জানান মিঃ রাজ্জাক। তাঁর মতে, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর এই হার দিয়ে সরকার পতন হবে না, তাছাড়া সংসদীয় আসনের সব সিটই পাওয়ার প্রয়োজনীয়তাও নেই।
তবে প্রার্থী নির্ধারণের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের আরো সচেতনতার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করছেন মিঃ রাজ্জাক।
মিঃ রাজ্জাক বলেন, “আমাদের ভুলভ্রান্তিগুলো, আমাদের দুর্বল দিকগুলো আইডেন্টিফাই করবো। এবং সেভাবে আমরা পদক্ষেপ নেবো - যাতে করে আগামী দিনে আমরা আরো ভালো করতে পারি।"
" আমাদের জন্য আরো সচেতন হওয়ার, আরো সাবধান হওয়ার এবং আরো চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আগানোর সময় এসেছে” - বলেন তিনি।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ইচ্ছা এবং বিশ্বাস তৈরি হওয়া জরুরী বলে জানাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী
সরকার যে আগের নির্বাচনকে ঘিরে নানা ত্রুটি বিচ্যুতি গোচরে নিচ্ছে এমন ধারণা অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তীরও - বিশেষত নির্বাচনকে সুষ্ঠু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
"তবে নির্বাচনকে ঘিরে পূর্ণাঙ্গ আস্থার সাথে সব রাজনৈতিক দলের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণটাও গুরুত্বপূর্ণ" - মিঃ চক্রবর্তীর মতে, "বাংলাদেশের রাজনীতি সবসময় সাংঘর্ষিক যেটা থেকে উত্তরণের জন্য দলগুলোকে পরস্পরের প্রতি একটা আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে নয়তো দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সংকীর্ণই থেকে যাবে।"
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এনএন বিডি ডেস্ক
মন্তব্য করুন